কিতাবঃ শরহে মুসনাদে ইমাম আ‘যম আবু হানিফা 

[ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর সংকলিত কিতাব মুসনাদে ইমামে আজমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ]

ব্যাখ্যাকারঃ হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি

আরবি প্রভাষকঃ

জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

ষোলশহর, চট্টগ্রাম। ০১৮১৭-২৩২৩৬৪

টেক্সট রেডীঃ 

মাসুম বিল্লাহ সানি ও সিরাজুম মুনির তানভীর















শরহে মুসনাদে ইমাম আ‘যম আবু হানিফা 

হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি

প্রকাশক : আলহাজ্ব রশিদ আহমদ

গ্রন্থস্বত্ব : অনুবাদক কর্তৃক সংরক্ষিত

প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৩ ঈসায়ী

দ্বিতীয় প্রকাশ : ফেব্র“য়ারী ৩, ২০১৫ ঈসায়ী

     চিশ্তি প্রকাশনী, বালুচরা, বায়েজীদ, চট্টগ্রাম।

কম্পোজ : এট্যাচ এ্যাড কম্পিউটার, আন্দরকিল্লা।

প্রচ্ছদ : মোহাম্মদ আলী, টাইপোগ্রাফিক্স, আন্দরকিল্লা।

মূল্য :  (২২০/-) দুইশত বিশ টাকা মাত্র













উৎসর্গ

আমার জান্নাতবাসী পিতা-মাতা

যথাক্রমে-মরহুম আহমদ জরিফ

মরহুমা আলহাজ্বাহ্ আনোয়ারা বেগম                             

               ও

প্রকাশকের জান্নাতবাসী পিতা

মরহুম তোফায়েল আহমদ



প্রকাশকের কথা 

আল্হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াস্সালাতু ওয়াসসালামু আলা রাহমাতালি­ল আলামীন, ওয়া আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন।

আম্মাবা’দ! ইসলামী শরায়ীহ ভিত্তিক জীবন-যাপনে বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণ প্রধানত হানাফী মাযহাবের অনুসারী। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله)’র মতে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মুসলিম হানাফী মাযহাবের অনুসারী ও অনুগামী। (মিরকাত, খণ্ড. ১, পৃ. ২৪) এর প্রধান কারণ হলো এ মাযহাব সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস ভিত্তিক এবং গণমানুষের স্বাভাবিক জীবনধারার সাথে গভীর মিল রয়েছে এ মাযহাবের।

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের অবহেলার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে হানাফী মাযহাবের প্রতি চিরবিদ্বেষ পোষণকারী ভ্রান্তদল লা-মাযহাবী তথা আহলে হাদীস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে কিংবা বিনা মূল্যে বই বিতরণের মাধ্যমে হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার প্রচার করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

এহেন পরিস্থিতিতে হানাফী মাযহাবের প্রামাণিক গ্রন্থ ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (رحمة الله) ’র বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ‘মুসনাদে ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’ ’র বাংলা ভাষায় ব্যাখ্যাসহ অনুবাদ অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশিষ্ট লিখক বন্ধুবর হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি গ্রন্থখানার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ বাংলাভাষায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থখানি বর্তমানে প্রত্যেক বাংলাভাষী হানাফী মুসলমানের হাতে থাকা উচিত। এ গুরুত্ব বিবেচনা করে গ্রন্থখানা প্রকাশের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করি। আশাকরি গ্রন্থখানা পাঠকের মনপুত এবং স্বীয় মাযহাবের উপর অটল থেকে জীবন-যাপনে সহায়ক হবে। আর এটিই আমাদের কাম্য।

গ্রন্থখানার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সচেতন বিজ্ঞ পাঠক মহল ও শুভাকাক্সক্ষীর গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে। পরিশেষে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র উসিলায় আল্লাহর রহমত প্রত্যাশা করি। 

আলহাজ্ব রশিদ আহমদ

হিলভিউ, চট্টগ্রাম।





অনুবাদকের কথা 


সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা বিশ্বের অনন্ত অসীম মহান স্রষ্টার জন্য, যিনি তাঁর নিখুঁত ঐশীবাণী অবতীর্ণ করে মানবজাতিকে পরম ধন্য করেছেন। সহস্র দরূদ-সালাম প্রেরণ করছি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (ﷺ)’র প্রতি যাঁর মুখনিসৃত বাণী অহীর অন্তর্ভুক্ত। আর স্মরণ করি সকল সাহাবী, তাবেঈ, তবে তাবেঈ ও আইম্মায়ে শরীয়ত যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে আমরা আল্লাহর ঐশীবাণী তথা কুরআন-হাদীসকে নিখুঁতভাবে পেয়েছি।

ইসলামী শরীয়তের মূল উৎস হল কুরআন ও সুন্নাহ। কুরআন দ্বারা যেমন ফরয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম সাব্যস্ত হয় অনুরূপভাবে সুন্নাহ দ্বারাও ফরয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম সাব্যস্ত হয়। ইলম ও আমল আবশ্যক হওয়ার দিক দিয়ে সুন্নাহ কুরআনের সমকক্ষ। সুন্নাহ কুরআনের সঠিক ও সাবভৌম ব্যাখ্যা। সুতরাং একটি অপরটির পরিপূরক।

কুরআন সুন্নাহর উপর ব্যাপক গবেষণা করে যারা মাসয়ালা-মাসায়েল উদঘাটন করে মানুষকে সহজভাবে আমল করার সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম আ‘যম আবু হানিফা নু‘মান ইবনে সাবিত (رحمة الله)। তিনি একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস-মুজতাহিদ ও ফকীহ ছিলেন। তিনি তাবেঈ ছিলেন বলে মাত্র এক, দুই ও তিনজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)  থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদিস সমূহকে তাঁর যোগ্য শিষ্যরা একত্রিত করে ‘মাসানীদে ইমাম আ‘যম’ নামে প্রকাশ করেছেন। তম্মধ্যে একটি হলো মুসনাদে আল্লামা হাফসাকী (رحمة الله)। হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) আরবী ভাষায় এই মুসনাদের ব্যাখ্যা করেছেন। এই মুসনাদ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবিদ সিন্ধী (رحمة الله) সংকলন করেছেন। মাওলানা দোস্ত মুহাম্মদ শাকের এটির উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। কিতাবটি সংগ্রহ করে কয়েকবার অধ্যয়ন করে বাংলা ভাষায় সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ এর অনুবাদ করার গুরুত্ব অনুভব করেছি। কারণ বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী। অথচ এই মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মুসনাদে ইমাম আ‘যম নামক অতীব গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের কিতাবটি সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞ। কিতাবটির ব্যাখ্যার কিছু কিছু স্থানে বিয়োজন আবার কিছু কিছু স্থানে বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থের রেফারেন্স, গ্রন্থকারের নাম ও কিতাবের পৃষ্ঠা নম্বর সহ সংযোজন করা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে রেফারেন্স ছাড়া যেসব হাদীস উল্লেখিত আছে সেগুলোর মূল গ্রন্থের নাম, লিখকের নাম এবং পৃষ্ঠা নম্বর সহ উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া মূল গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহ অন্যান্য যেসব কিতাবে বর্ণিত আছে তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিতাবের নাম, পৃষ্ঠা নম্বর ও হাদিস নম্বর সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’র ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন ও হাফেজ মুহাম্মদ বেলাল হোসেন যথেষ্ট পরিশ্রম করে সহযোগিতা করেছে। হরফবিন্যাস করেছেন শেখ তৈয়ব মাহমুদ প্রিন্স, এট্যাচ এ্যাড কম্পিউটারের সিস্টেম অফিসার। সর্বোপরি গ্রন্থটি আলিম-ওলামা, ইসলামী গবেষক, মাদ্রাসার ছাত্রসহ সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের জন্য অতীব প্রয়োজন মনে করে অনুবাদের প্রয়াস পেয়েছি।

গ্রন্থটি নিখুঁত ও নির্ভুল করতে চেষ্টা ও আন্তরিকতার ত্রুটি ছিলনা। তবুও মুদ্রণ ও তথ্যপ্রমাদ থাকতে পারে। বিজ্ঞ পাঠকমহলের দৃষ্টিগোচর হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে অবহিত করলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা হবে।

পরিশেষে প্রকাশক সহ যাদের পরিশ্রমের দ্বারা গ্রন্থটি প্রকাশিত হলো সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল এবং আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি যেন অধম সহ সংশ্লিষ্ট সকলের এ উসিলায় পরকালে নাজাত নসীব হয়। আমীন, বেহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।


হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গণি
















সূচীপত্র   


   


  •    




ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র জীবনী


নাম ও জন্ম: 


নাম: নো‘মান, উপনাম আবু হানিফা, পিতার নাম- সাবিত, উপাধি: ইমাম আ‘যম, ইমামুল আইম্মাহ, সিরাজুল উম্মাহ, রঈসুল ফুকাহা, ওয়াল মুজতাহিদীন, সায়্যেদুল আউলিয়া ওয়াল মুহাদ্দিসীন, হাফেযুল হাদীস। পূর্ণ নাম- নো‘মান ইবনে সাবিত ইবনে নো‘মান ইবনে মারযুবান। তারীখে বাগদাদ গ্রন্থে খতীব বাগদাদী (رحمة الله) ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র পৌত্র ইসমাঈল থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন- “আমি ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ ইবনে সাবিত ইবনে নো‘মান ইবনে মারযুবান। আমরা পারস্য বংশোদ্ভুত এবং কখনো কারো দাসে পরিগণিত হইনি। আমার দাদা ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সাবিত শৈশবকালে হযরত আলী (رضي الله عنه)’র খেদমতে হাযির হয়েছিলেন। তিনি তাদের বংশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য দোয়া করেছিলেন। আমরা আশা করি তাঁর ঐ দোয়া কবুল হয়েছে।” 

    হাফিয আবু বকর আহমদ ইবনে আলী খতীব বাগদাদী (رحمة الله) (৪৬৩), তারীখে বাগদাদ, খণ্ড-১২, পৃ ৩২৬

 

ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র পূর্বপুরুষের মধ্যে কেউ কখনো কারো গোলাম ছিলেন না। তবে আরবে একটা নিয়ম ছিল যে, যখন কোন দুর্বল ব্যক্তি বা ভিন দেশীকে কোন গোত্র আশ্রয় কিংবা সহযোগিতা বা নিরাপত্তা দান করে তখন তাকে مولي (মাওলা) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে এবং তার ব্যাপারে هذا مولائى বাক্য ব্যবহার করে থাকে। ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র দাদা আরবের কোন গোত্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন এবং এই সম্পর্কের কারণে তিনি মাওলা (যা গোলাম অর্থেও ব্যবহার হয়) হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। ইমাম তাহাভী (رحمة الله) ‘শরহে মশকিলুল আসার’ গ্রন্থে বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযিদ বলেন, আমি ইমাম আ‘যমের খেদমতে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি কে? আমি বললাম-আমি এমন ব্যক্তি যার উপর আল্লাহ তায়ালা ইসলামের দ্বারা ইহসান করেছেন। অর্থাৎ আমি নও মুসলিম। ইমাম আ‘যম বললেন, এরূপ বলোনা, বরং ঐ সব গোত্র থেকে কোন একটির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোল, তারপর তোমার সম্পর্কও তাদের দিকে হবে। আমি নিজেও এরূপ ছিলাম।  

    ইমাম তাহাভী (رحمة الله) (৩৬১হি) মশকিলুল আসার, খণ্ড- ৪, পৃষ্ঠাঃ  ৫৪

 

ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদের বর্ণনানুযায়ী অধিকাংশ ওলামায়ে কিরামের মতে তিনি ৮৪ হিজরী সনে জন্ম লাভ করেন এবং ১৫০ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله)’র মতে তিনি ৭৭ হিজরীতে জন্ম লাভ করেন।

আল্লামা কাওসারী দলীল প্রমাণ দিয়ে ৭০ হিজরী বলেছেন এবং এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ৮৭ হিজরী সনে স্বীয় পিতার সাথে হজ্জে গিয়েছিলেন এবং সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস (رضي الله عنه)’র সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর থেকে হাদিসও শ্রবণ করেন। ইবনে হিব্বানও ৭০ হিজরীকে বিশুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ হিসাবে প্রথম মতানুযায়ী তাঁর বয়স ৭০ বছর, দ্বিতীয় মতানুযায়ী হয় ৭৩ বছর আর তৃতীয় মতানুযায়ী হয় ৮০ বছর।  

➥      মাওলানা হানিফ খান রেজভী, মুকাদ্দামা জামেউল আহাদীস, পৃষ্ঠাঃ  ২২৯

 

ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) তাঁর নামের ব্যাখ্যা ও রহস্য সম্পর্কে বলেন, সকলেরই ঐকমত্য যে, তাঁর নাম নো‘মান এবং এতে এক গুঢ় রহস্য রয়েছে। কেননা নো‘মান মূলতঃ ঐ রক্তকে বলে যার মাধ্যমে শরীরের কাঠামো ঠিক থাকে। এ কারণে কেউ কেউ বলেন এটি শরীরের রূহ। ইমাম আ‘যম আবু হানিফার কারণে ফিকহ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এবং তাঁর দ্বারাই ফিকহের দলীলাদি ও দূরহ মাসয়ালা সমাধান হয়েছে। অথবা নো‘মান এক প্রকারের লাল বর্ণের সুগন্ধি ঘাস বা এক প্রকার সুগন্ধিযুক্ত রক্তকে নো‘মান বলা হয়। এর দ্বারা তাঁর উত্তম চরিত্র ও পূর্ণতা লাভের দিকে ইঙ্গিত বহণ করে। অথবা নো‘মান فعلان এর ওযনে নিয়ামত অর্থ থেকে নির্গত। এ অর্থে তিনি সমগ্র সৃষ্টির জন্য আল্লাহর নিয়ামত স্বরূপ।  

    ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩ হিঃ) আল খায়রাতুল হিসান আরবী, পৃষ্ঠাঃ   ৪৪, পাকিস্তান

 

ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র উপনাম আবু হানিফা হওয়ার কারণ বর্ণনায় বলেন, তাঁর উপনাম আবু হানিফা এ ব্যাপারেও সবাই একমত। হানিফা শব্দটি ‘হানিফুন’ এর স্ত্রীলিঙ্গ। যার অর্থ হলো নাসেক, আবেদ ও মুসলিম। কেননা হানিফ শব্দের অর্থ হলো ধাবিত হওয়া। মুসলিমরা দ্বীনে হকের দিকে ধাবিত হয়। তাই তার উপনাম আবু হানিফা। কেউ কেউ বলেছেন তাঁর উপনাম আবু হানিফা হওয়ার কারণ হলো-তাঁর নিকট সর্বদা (লিখার জন্য) দোয়াত থাকত। ইরাকী ভাষায় এটাকে হানিফা বলা হয়।  

    ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩ হিঃ) আল খায়রাতুল হিসান আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৪৫


ইমাম আ‘যম (رحمة الله) সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) এর অগ্রিম সুসংবাদ


ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র শুভাগমন সম্পর্কে রাসূল (ﷺ)  এর সুসংবাদ সম্বলিত অনেক হাদিস ‘দুররুল মুখতার’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে। তবে বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু হোরায়রা (رضي الله عنه) বলেন, আমরা রাসূল (ﷺ) ’র খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। এই মজলিসে সূরা জুমা অবতীর্ণ হয়েছে। যখন রাসূল (ﷺ)  এ সূরার আয়াত وَاخِرِيْنَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوْابِهِمْ তিলাওয়াত করেন। তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ লোকগণ কারা যারা এখনো আমাদের সাথে মিলিত হয়নি? তিনি এ প্রশ্ন শ্রবণ করে চুপ রইলেন। যখন বার বার প্রশ্ন করা হলো তখন তিনি হযরত সালমান ফার্সীর কাঁধে হাত মোবারক রেখে বললেন,

-لَوْ كَانَ الاِيْمَانُ عِنْدَ الثُرِيَّا لَناَ لَه رَجُلٌ مِنْ هؤلَاءِ 

“ঈমান যদি তারকারাজিতেও থাকে তবুও এর সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি সেখান থেকে তা অন্বেষন করে নেবে।”  

 ➥    ইমাম মুসলিম (رحمة الله) হিঃ ২৬১, সহীহ মুসলিম, বাবু ফদ্বলে ফারেস, হাদিস নং ৬৩৭৫


রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ ওলামাদের মতানুযায়ী ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র দাদা পারস্যবাসী ছিলেন। শাফেঈ মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله) বলেন-এই হাদিসটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসের বিশুদ্ধতার উপর সবাই একমত এবং এতে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ফযায়েল ও মানাকেবের জন্য এ হাদিসটিই যথেষ্ট। হাফেয সুয়ূতীর শাগরিদ শামী লিখেছেন, আমাদের উস্তাদ দৃঢ়তার সাথে যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ সত্য ও বিশুদ্ধ। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই হাদিস দ্বারা ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)ই উদ্দেশ্য। কেননা, পারস্যবাসীদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফার ফযীলত ও মর্যাদা পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারেনি।      আল্লামা সৈয়দ আমীন ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) ১৩০৬ হিঃ, রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৪৯ ও ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩ হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৩১, উর্দু পৃষ্ঠাঃ ৩৫

 

ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) আরো বলেন, ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণীর বিষয়টি এ হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত হয়,

 تُرْفَعُ زِيْنَةُ الدُّنْيَا سِنَةَ خَمْسِيْنَ وَمِائَةٍ 

“১৫০ হিজরীতে দুনিয়ার সৌন্দর্য উঠে যাবে।” প্রখ্যাত ফিকাহ বিশেষজ্ঞ শামশুল আইম্মা আব্দুল গাফফার কুরদরী (رحمة الله) (৫৬২ হি.) বলেন:

 اَنَّ هذَا الحَدِيْثَ مَحْمُولٌ عَلى اَبيِ حَنِيْفَةَ لاِ نَّه مَاتَ تِلْكَ السِّنَةَ  

এ হাদিস দ্বারা আবু হানিফা (رحمة الله)ই উদ্দেশ্য। কারণ তিনি ঐ বছরই তথা ১৫০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন।

    ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله)(৯৭৩হিঃ) খায়রাতুল হিসান, আরবী পৃষ্ঠাঃ  ৩৩ ও আহমদ জুদত পাশা, আল মালুমাতুন নাফিয়া, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৪৪


জ্ঞানার্জন: 


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় দ্বীনি ইলম শিক্ষার্জন করার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। একদিন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাজারে যাওয়ার পথে ইমাম শা’বী (رحمة الله)’র সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি তাঁর চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও সৌভাগ্যের আলামত পরিলক্ষিত করে তাঁকে কাছে ডেকে বললেন, কোথায় যাচ্ছ? উত্তরে তিনি বললেন-বাজারে যাচ্ছি। শা’বী বললেন-ওলামাদের মজলিসে বসনা? বললেন না। শা’বী বললেন, তুমি ওলামাদের মজলিসে বস, কেননা আমি তোমার চেহারায় জ্ঞান ও ফযীলতের চিহৃ দেখতে পাচ্ছি।  

    ইমাম মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী (رحمة الله)(৫৬৮হিঃ) মানকিবে ইমাম আ‘যম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৫৯

 

ইমাম শা’বী (رحمة الله)’র সাথে সাক্ষাতের পর ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র অন্তরে ইলমে দ্বীনের সর্বোচ্চ জ্ঞানার্জনের আগ্রহ সৃষ্টি হলো। তিনি প্রথমত ইলমে কালাম শিক্ষা আরম্ভ করেন। এ বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জনের পর বিভিন্ন বাতিল ফির্কার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হন। কিছু দিন এভাবে অতিক্রম হওয়ার পর তিনি চিন্তা করলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম দ্বীনি বিষয়ে সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে জবরীয়া ও কদরীয়া ইত্যাদি বাতিল ফির্কাদের বিতর্কিত মাসয়ালায় জড়িত হননি। বরং এর বিপরীত শরয়ী ও ফিকহী মাসয়ালার দিকে তাঁদের মনোযোগ ছিল বেশী। যদি ইলমে কালাম এতই গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে তাঁরা কখনো তা পরিত্যাগ করতেন না। এই খেয়াল মনে জাগ্রত হওয়ার পর তিনি ইলমে কালাম পরিত্যাগ করে ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকহের প্রতি মনোনিবেশ করেন।      ইমাম মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী (رحمة الله)(৫৬৮হিঃ) মানকিবে ইমাম আ‘যম, পৃষ্ঠাঃ  ৬০।


ইলমে ফিকহের প্রতি ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র মনযোগের আরও একটি কারণ হলো তিনি একরাতে স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি রাসূল (ﷺ) ’র কবর শরীফ খনন করতেছেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারী সবচেয়ে বড় আলিম ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (رحمة الله)’র নিকট এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলে তিনি বলেন, আপনি রাসূল (ﷺ) এর হাদিস ও সুনান থেকে মাসয়ালা বের করবেন এবং এমন কঠিন বিষয়ের সমাধান করবেন যা ইতিপূর্বে কেউ করেননি। তিনি এই স্বপ্নকে অদৃশ্যের ইঙ্গিত মনে করে পূর্ণ মনযোগ সহকারে ইলমে ফিকহ অর্জনে ব্রত হলেন।  

    ইমাম মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী (رحمة الله)(৫৬৮হিঃ) মানকিবে ইমাম আ‘যম, খণ্ড ১, ৬৭।


কূফার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হাম্মাদ ইবনে সোলায়মান (رحمة الله) জামে কূফায় পাঠদান করতেন। আর এই পাঠদান পদ্ধতি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (رضي الله عنه)’র আমল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসতেছে। তৎকালে কূফা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণ কেন্দ্র। প্রায় পনেরশত সাহাবী এই শহরে এসে এটাকে আবাদ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সত্তরজন ছিলেন বদরী সাহাবী এবং তিনশত জন ছিলেন বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবী। যার ফলে কূফার প্রতিটি ঘর হয়ে উঠেছিল দারুল হাদিস ও দারুল উলুম। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ সময় কূফায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (رضي الله عنه) সাহাবীয়ে রাসূল (ﷺ)বিদ্যমান ছিলেন।

হযরত ওমর (رضي الله عنه) ইবনে মসউদ (رضي الله عنه)কে কূফার কাযী এবং বায়তুল মালের দায়িত্বে নিয়োগ দিয়ে কূফায় প্রেরণ করেন। আসরারুল আনোয়ার গ্রন্থে বর্ণিত আছে- কূফায় ইবনে মসউদের মজলিসে একই সময় চার হাজার ছাত্র উপস্থিত হতেন। একদা হযরত আলী (رضي الله عنه) কূফায় আগমন করলে ইবনে মসউদ (رضي الله عنه) তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য আগমন করেন। এ সময় সমস্ত ময়দান তাঁর শিষ্যে পূর্ণ হয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে হযরত আলী (رضي الله عنه) সন্তুষ্টি হয়ে বলেন, হে ইবনে মসউদ! তুমি তো কূফাকে ইলমে ফিকহ দিয়ে ভরে দিয়েছ। তোমার বদৌলতে এ শহর জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো।  

    মাওলানা হানিফ খান রেজভী, মুুকাদ্দমা, জামেউল আহাদীস, পৃষ্ঠাঃ ২৩৩

 

হযরত ওমর (رضي الله عنه) এ শহরকে

 رَأْسُ العَرَبِ ، رَأْسُ السَّلاَمِ বলে আখ্যায়িত করেছেন। 

হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه)-

 قُبَّةُ الاِسْلاَمِ উপাধিতে ভুষিত করেন। 

হযরত আলী (رضي الله عنه) -

كَنْزُ الاِيْمَانِ (ঈমানের খযিনা) 

جَمْجَمَةُ الاِسْلَامِ (ইসলামের মগজ)  

رَمْحُ اللهِ (আল্লাহর তীর) ও  

سَيْفُ اللهِ (আল্লাহর তলোয়ার) বলে উল্লেখ করেছেন।  

    মুফতি মুহাদ্দিস শরীফুল হক আমজাদী, নুযহাতুল কারী শরহে বুখারী, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ১১

 

ইমাম আ‘যম (رحمة الله) হযরত হাম্মাদ (رحمة الله)’র পাঠদান মজলিসে উপস্থিত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিয়মানুযায়ী নতুন ছাত্র হিসেবে তাঁকে প্রথমে বাম সারিতে বসাতেন। হাম্মাদ যখন তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা অনুধাবন করলেন, তখন তাকে ডান সারিতে এবং সবার আগে সামনে বসার অনুমতি প্রদান করেন। তিনি যখন ইমাম হাম্মাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স বিশ বছর অতিক্রম করেছিল। তিনি আঠার বছর পর্যন্ত খেদমতে থেকে ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকহ অর্জন করেন। তিনি নিজেই ইমাম হাম্মাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ সম্পর্কে বলেন-আমি দশ বছর পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যে ছিলাম। অতঃপর আমার মনে সম্মান অর্জনের খেয়াল আসল। ফলে আমি পৃথক পাঠদান মজলিস প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে পোষণ করেছি। একদিন এ উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বের হলাম এবং মসজিদে পা রেখেই হযরত শেখ হাম্মাদকে দেখে তাঁর থেকে পৃথক হয়ে বসা আমার পছন্দ হলো না। তাই তাঁর মজলিসে গিয়ে বসে পড়েছি। ঐ রাতে হযরত হাম্মাদ অবহিত হলেন যে, তাঁর এক আত্মীয় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। অনেক সম্পদ রেখে যান তিনি, এবং হযরত হাম্মাদ ছাড়া অন্য কোন ওয়ারিশ ছিলনা তার। তিনি আমাকে তাঁর স্থানে বসিয়ে বসরায় চলে গেলেন। ইত্যবসরে আমার নিকট এমন এমন মাসয়ালা আসল যা আমি আজ পর্যন্ত তাঁর থেকে শুনিনি। তবে প্রত্যেক মাসয়ালার আমি উত্তর দিয়েছি এবং তা লিখে রেখেছি। এরূপ প্রায় ষাটটি মাসয়ালা হলো। যখন তিনি বসরা থেকে ফিরে আসেন তখন আমি ঐ মাসয়ালা সমূহ তাঁর সামনে পেশ করেছি। তিনি চলি­-শটি মাসয়ালায় ঐক্যমত পোষণ করেছেন এবং বাকী বিশটি মাসয়ালায় আমার বিপরীত জবাব দিয়েছেন। আমি ঐদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, হাম্মাদের জীবদ্দশায় তাঁর সাহচর্য ত্যাগ করবো না। সুতরাং তিনি উস্তাদ হাম্মাদের ইন্তেকাল ১২০ হিজরী পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যে ছিলেন। এ সময় ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র বয়স হয়েছিল চল্লিশ বছর। উস্তাদের ইন্তেকালের পর চলি­¬শ বছর বয়সে তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হন এবং ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকহ পাঠদানে লিপ্ত হন।


জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে দেশভ্রমণ


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ইলমে হাদিস অর্জনের জন্য কূফা ছাড়াও মক্কা, মদীনা ও বসরা বহুবার গমন করেছিলেন। মূলত তৎকালে এ চারটি শহরই ছিল জ্ঞানচর্চা বিশেষত হাদিস চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। আগেই বলা হয়েছে যে, কূফা নগরী পনেরশত সাহাবী ও অসংখ্য তাবেঈগণের পদচারণায় হাদিস চর্চার মরকযে পরিণত হয়েছিল। কূফায় এমন কোন মুহাদ্দিস বাকী ছিলেন না যাঁর ছাত্র হয়ে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেননি।

হযরত ওমর (رضي الله عنه)’র নির্দেশে বসরা আবাদ হয়েছিল। কূফার ন্যায় এ শহরেও অনেক প্রখ্যাত মুহাদ্দীস ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) অনেকবার বসরা গমণ করে তাঁদের থেকে ইলমে হাদিস অর্জন করেন। ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে শায়বান (رحمة الله) ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন:

 دَخَلتُ البَصَرَنِيْفًا وَعِشْرِيْنَ مَرَّةً مِنْهَا مَا اُقِيْمُ سَنَةَ وَاَقَلَّ وَاَكْثَرَ 

“আমি বিশ বারের অধিক বসরায় গমণ করেছি। এতে কখনো এক বছর কখনো এর চেয়ে কম আবার কখনো এর চেয়ে বেশী সময় পর্র্যন্ত অবস্থান করেছি।”           

    

মক্কা-মদীনায় গমনঃ 


তিনি জীবনে মোট ৫৫ বার হজ্জ পালন করেন। তাছাড়া ১৩০ হিজরী থেকে ১৩৬ হিজরী পর্যন্ত তিনি মক্কা-মদীনায় অবস্থান করেন। এসব হিসাব করলে দেখা যায় তিনি প্রায় দশ বছর মক্কা-মদীনায় অবস্থান করেন। এ দীর্ঘ সময়ে সেখানে অবস্থিত প্রখ্যাত মুহাদ্দিসীনে কিরাম সহ পবিত্র হজ্জ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বড় বড় মুহাদ্দিসীনে কিরাম থেকে ইলমে হাদিস অর্জন করেন। এ সময়ে ইমাম আওযাই ও ইমাম মকহুল (رحمة الله)’র সাক্ষাত লাভে ধন্য হন এবং এঁদের থেকে হাদিসের সনদ লাভ করেন। তাছাড়া পবিত্র মদীনায় হযরত ইমাম বাকির (رحمة الله)’র সান্নিধ্য লাভ করেন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁর খেদমতে থেকে তাঁর থেকে ফিকহ ও হাদিসের অনেক মূল্যবান তথ্য ও জ্ঞান লাভ করেন। তিনি ইমাম বাকির (رحمة الله)’র পুত্র হযরত জাফর সাদিক (رحمة الله) থেকে ইলমে হাদিস অর্জন করেন। এভাবে তিনি চার হাজার উস্তাদ থেকে ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহ অর্জন করেছেন যাঁদের মধ্যে কয়েকজন সাহাবী সহ অধিকাংশ ছিলেন প্রসিদ্ধ তাবেঈ।


তাঁর বিশিষ্ট কয়েকজন উস্তাদের নামঃ  


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) সাহাবী সহ উল্লেখযোগ্য তাবেঈগণ থেকে ইলমে হাদিস অর্জন করেন, যাদেরকে হাদিস শাস্ত্রের ইমাম ও হুজ্জত হিসাবে গণ্য করা হয়। সদরুল আইম্মা ইমাম মুয়াফ্ফিক (رحمة الله) আবু আব্দুল্লাহ ইবনে হাফ্সের উদ্ধৃৃতি দিয়ে তাঁর উস্তাদের সংখ্যা চার হাজার উল্লেখ করেছেন।

    ইমাম মুয়াফিফক ইবনে আহমদ (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ), মানাকিবে ইমাম আ‘যম, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ৩৮


বিভিন্ন মুহাদ্দিসগণ যেসব প্রসিদ্ধ উস্তাদগণের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন সাহাবী তথা হযরত আনাস ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (رضي الله عنه) হলেন অন্যতম। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) নিন্মোক্ত উস্তাদগণের নাম উল্লেখ করেছেন। 

১. আতা ইবনে রাবাহ মক্কী (১১৪হি.) 

২. আসিম ইবনে আবিন  নজওয়াদ কূফী, 

৩. আলকামা ইবনে মারসাদ কূফী,

৪. হাম্মাদ ইবনে আবি সোলায়মান (১২০হি.) 

৫. হাকাম ইবনে কুতাইবা কূফী 

৬. সালমা ইবনে কুহাইল কূফী 

৭. আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী তথা ইমাম বাকির (১১৪ হি.) 

৮. আলী ইবনে আহমার বা আকমার কূফী 

৯. যিয়াদ ইবনে আলকা কূফী,

১০. সাঈদ ইবনে মসরূক সওরী , 

১১. আদী ইবনে সাবিত আনসারী, 

১২. আতিয়্যাহ ইবনে সাঈদ আওফী, 

১৩. আবু সুফিয়ান সা’দী, 

১৪.আব্দুল করিম আবু উমাইয়্যা, 

১৫.ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আনসারী ও 

১৬.হিশাম ইবনে উরওয়া।  

    ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) (৮৫২হিঃ) তাহযীবুত তাহযীব, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ৪৪৯

 

হাফিয যাহাবী (رحمة الله) এঁদের ছাড়া যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন-তাঁরা হলেন, 

১৮.হযরত না‘ফে মাদানী (১২০ হি.), 

১৯.আব্দুর রহমান ইবনে হুরমুজা আল মাদানী (১১৭ হি.), 

২০. কাতাদাহ (১২৭ হি.) 

২১.আমর ইবনে দীনার আল মক্কী, ২২.আবু ইসহাক সাবঈ আল কূফী (১২৭ হি.)। 

    শামশুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) (৭৪৮হিঃ), তাযকারাতুল হুফফায, খণ্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১৬৮


মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) আরো কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেন, 

২৩.রবীয়া, 

২৪.যায়েদ ইবনে আসলাম, 

২৫. শো’বা ইবনে হাজ্জাজ, 

২৬.আবু বকর ইবনে আসিম এবং 

২৭.আমের ইবনে শুরাহবীল আল কূফী (১০৩ হি.)।  

    মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হি), জওয়াহিরুল মুদিয়্যাহ, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ  , ৪৫৪


২৮ হযরত ইকরামা মাওলা ইবনে আব্বাস আল মক্কী (১০৭ হি.), 

২৯.মুহারিব ইবনে দিসার আলকূফী (১১৬হি.), 

৩০. মুহাম্মদ ইবনে দিসার আলকূফী, 

৩১. মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির, 

৩২. ইবনে শিহাব যুহুরী, 

৩৩.আবু যুবাইর আলমক্কী (১২৭হি.), 

৩৪. সিমাক ইবনে হারব আলকূফী, 

৩৫. কায়েস ইবনে মুসলিম আলকূফী, 

৩৬. ইয়াযিদ ইবনে সুহাইব আলকূফী, 

৩৭. আব্দুল আজীজ আলকূফী, 

৩৮.আবু যোবায়ের মুহাম্মদ মুসলিম আলমক্কী, 

৩৯.মনসুর ইবনে মু’তামির আলকূফী ও 

৪০. সোলায়মান ইবনে মেহরান (رحمة الله)।  

    ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, পৃষ্ঠাঃ  ১২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ


তাঁর বিশিষ্ট কয়েকজন ছাত্রের নামঃ 


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) উস্তাদ হাম্মাদের ইন্তেকালের পর উস্তাদের হালকায়ে দরসের স্থলাভিষিক্ত হন। অল্প দিনের মধ্যে তাঁর দরস-তদরীসের সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞান পিপাসু ছাত্রগণ তাঁর দরসে অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। তৎকালে অন্য কোন মুহাদ্দীস বা ফকীহর এত সংখ্যক ছাত্র ছিলনা। মক্কা মুয়াযযমা, মদীনা মুনাওয়ারা, দামেশক, বসরা, কূফা, ওয়াসিত, মু’সিল, জাযীরা, রিককা, রামাল্লাহ, মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইন, বাগদাদ, আহওয়ায, কিরমান, ইস্কাহান, হালওয়ান, হামদান, দাগমান, তাবারিস্থান, জুরযান, সারাখ্স, নিশাপুর, বুখারা, সমরকন্দ, তিরমিয, বলখ, কুহিস্থান, খাওয়ারিজম, সিজিস্থান, মাদইয়ান, হিম্স ইত্যাদি এলাকার সহস্র শিক্ষার্থী ইমাম আ‘যমের দরসে শরীক হন, এবং কুরআন, হাদীস, ফিকহ সহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। 

ইমাম আ‘যমের ছাত্রদের মধ্যে বহুসংখ্যক কুরআন বিশেষজ্ঞ, ফকীহ, মুহাদ্দিস ও বিচারক ছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মধ্যে-

১.কাযী আবু ইউসুফ (১৮৩ হি.), 

২. মুহাম্মদ ইবনে হাসান আস শায়বানী (১৮৯হি.), 

৩.যুফার, (১৫৮হি.), 

৪. হাম্মাদ ইবনে আবু হানিফা (১৭৬হি.), 

৫. হাসান ইবনে যিয়াদ, (২০৪ হি.) 

৬. আবু ইসমাত নূহ ইবনে মরিয়ম (১৭৩হি.), 

৭. কাযী আসাদ ইবনে আমর, 

৮. হাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ বালখী, 

৯.ফযল ইবনে মুসা (১৯২হি.), 

১০. মুগীরা ইবনে মিকসাম, 

১১. যাকারিয়া ইবনে আবু যায়দা, 

১২. আসাদ ইবনে উমর (১৮৮হি.)

১৩. মিসআর ইবনে কুদাম, 

১৪. সুফিয়ান সওরী, 

১৫. মালিক ইবনে মিগওয়াল, 

১৬. ইউসুফ ইবনে খালিদ (১৮৯হি.), 

১৭. ইউনুস ইবনে আবু ইসহাক, 

১৮. দাউদ তাঈ, (১৬০হি.), 

১৯. আফিয়া ইবনে ইয়াযিদ (১৬০হি.), 

২০. মিন্দাল ইবনে আলী (১৬০হি.), 

২১. হাসান ইবনে সালিহ, 

২২.আবু বকর ইবনে আইয়্যাশ, 

২৩.ঈসা ইবনে ইউনুস, 

২৪.আলী ইবনে মুসায়েব (১৮৯হি.), 

২৫.হাফস ইবনে গিয়াস (১৯৪হি.), 

২৬. ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (১৮২হি.), 

২৭.আবুল আসীম নাবীল (২১২হি.), 

২৮. জারীর ইবনে আব্দুল হামিদ, 

২৯.আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১হি.), 

৩০. ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (১৮৭হি.), 

৩১. হাব্বান ইবনে আলী (১৭২হি.), 

৩২.আবু ইসহাক ফাযারী, 

৩৩. ইয়াযিদ ইবনে হারূন (২০৬হি.), 

৩৪. আব্দুর রাজ্জাক ইবনে ইব্রাহীম, 

৩৫. আব্দুর রাজ্জাক হাম্মাদ সা’আনী, 

৩৬. আব্দুর রহমান আল মুকরী, 

৩৭. হায়শাম ইবনে বশীর, 

৩৮. কাসিম ইবনে মা’আন(১৭৫হি.), 

৩৯.আলী ইবনে আসীম, 

৪০. ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ কাত্তান (১৯৮হি.), 

৪১ জাফর ইবনে আউন, 

৪২. ইব্রাহীম ইবনে তাহমান (১৬৯ হি.), 

৪৩. হামযা ইবনে হাবীব (১৫৮ হি.), 

৪৪. ইয়াযীদ ইবনে রাফী, 

৪৫. যুবায়ের, 

৪৬. ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামান, 

৪৭. খারিজা ইবনে মুস’আব, 

৪৮. মুস’আব ইবনে কুদাম ও 

৪৯. রাবীয়া ইবনে আব্দুর রহমান রাঈ আল মাদানী (رحمة الله)।  

    ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, পৃৃ, ১৩০-৩১ ইফাবা


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) তাবেঈ ছিলেন


ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) বলেন, শায়খুল ইসলাম ইবনে হাজার (رحمة الله), আসকালানী (رحمة الله)’র ফতোয়া আছে যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) একদল সাহাবায়ে কিরামকে দেখেছেন, যারা তাঁর জন্মের (৮০ হিজরীর পর) কূফায় জীবিত ছিলেন। সুতরাং তিনি তাবেঈদের অন্তর্ভুক্ত। আর এই ফযীলত অন্যান্য শহরে অবস্থিত তাঁর সমসাময়িক কারো মধ্যে ছিলনা। যেমন আওযায়ী সিরিয়ায়, উভয় হাম্মাদ বসরায়, ইমাম সুফিয়ান সওরী কূফায়, ইমাম মালিক মদীনা শরীফে এবং ইমাম লায়স ইবনে সা’দ মিশরে ইন্তেকাল করেন। এঁদের কেউ তাবেঈ নন। আসকালানীর ফতোয়ার ইবারত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আ‘যম ঐসব সম্মানিত তাবেঈদের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে আল্লাহর এই বাণী প্রযোজ্য  হয়।

।وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ 

“যারা তাঁদের (আনাসার ও মুহাজির সাহাবীদের) অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রস্রবণসমূহ প্রবাহিত রয়েছে। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।” (সূরা তাওবা আয়াত; ১০০)


ইবনে খলি­কান ও ইমাম ইয়াফেঈ (رحمة الله) বলেন,

-وَاَدْرَكَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ اَرْبَعَةَ مِنَ الصَحَابَةِ وَهُمْ اَنَسِ بْنُ مَالِكِ بِالْبَصَرِةِ وَعَبْدُ اللهِ بْنِ اَبِيْ اَوْفى بِالْكُوْفَةِ وَسَهْلْ بنُ سَعَدِ السَّاعِدِي بِالْمَدِيْنَةِ وَاَبُوْ الطُفَيْلِ عَامِرْ بنِ وَاثَلَةَ بِمَكَّةَ 

- “ইমাম আবু হানিফা চারজন সাহাবীকে পেয়েছেন। তাঁরা হলেন-বসরায় হযরত আনাস ইবনে মালিক, কূফায় আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা, মদীনায় সাহল ইবনে সা’দ এবং মক্কায় আবু তোফায়েল আমের ইবনে ওয়াসেলা (رضي الله عنه)।”  

 ➥     ইবনে খলি­কান (৬৮৪হিঃ) ওয়াফিয়াতুল আইয়ান, খন্ড ৫, পৃষ্ঠাঃ   ৪০৬ ও ইমাম ইয়াফেঈ (رحمة الله) (৭৬৮ হিঃ) মিরআতুল জিনান ওয়া ইবরাতিল ইযকান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৩১০


ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ১৫০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন, এ সময় ২২ থেকে ২৭জন সাহাবী জীবিত ছিলেন। তন্মধ্যে ৪/৭/১০ জন সাহাবীর সাথে তার সাক্ষাতের বর্ণনা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। “দুররুল মোখতার ” গ্রন্থে ২০জন এবং “খোলাসায়ে ইকমাল” নামক গ্রন্থে ২৬ জন সাহাবীর সাথে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ আছে। তিনি নিজেই বলেছেন,

 رَأْيتُ انس بنِ مَالِك الكُوفة قَائِمًا يُصَلِّيٌ   

“আমি কূফায় হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه)কে দাঁড়িয়ে নামায পড়তে দেখেছি।”      আবু নুআঈম ইস্পাহানী (رحمة الله) (৪৩০ হিঃ) মুসনাদে ইমাম আবু হানিফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৬৭

 

তাযকারাতুল হুফফাযে বর্ণিত আছে,

 قَدِمَ اَنَس بْنِ مَالِكِ الكُوْفَةَ وَنَزَلَ النّخْعَ رَأْيتُه مَرَرًا 

“হযরত আনাস ইবনে মালিক (رضي الله عنه) কূফায় আগমন করেন এবং তিনি নাখায় অবতরণ করেন। আমি তাঁকে অনেকবার দেখেছি।”  

    শামশুদ্দিন যাহাবী (رحمة الله) (৭৪৮হিঃ) তাযকারাতুল হুফায, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১৬৮ 

 

আল্লামা মুহাম্মদ হাসান সান্বালী (رحمة الله) (১৩০৫ হি.) ইমাম আ‘যমের সময়কালে জীবিত ২২ জন সাহাবীর কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা হলেন- 

১. হযরত আনাস ইবনে মালিক, 

২.হযরত আসাদ ইবনে সাহাল ইবনে হানিফ, 

৩. হযরত বুসর ইবনে আরতাত, 

৪.হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ, 

৫. হযরত সাহাল ইবনে সা’দ আস সায়েদী, 

৬. হযরত আবু উমামা সুদা ইবনে আজলান, 

৭. হযরত তারেক ইবনে শিহাব বাজলী, 

৮. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আউফা, 

৯. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুসর, 

১০.হযরত আমর ইবনে সা’লাবা, 

১১.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারেস ইবনে মাউফল, 

১২.হযরত আমর ইবনে আবু সালমা,

১৩. .হযরত উতবা ইবনে আব্দুস সালামী, 

১৪. হযরত আমর ইবনে আবু সালমা, 

১৫. হযরত আবু তোফায়েল আমের ইবনে ওয়াসেলা, 

১৬. হযরত আমর ইবনে হুরাইস আল মাখযূমী, 

১৭. হযরত কুবাইসা ইবনে যুবাইর,  ১৮. হযরত মালেক ইবনে হুযাইরিস, 

১৯.হযরত মাহমুদ ইবনে লবীদ, 

২০. হযরত মিকদাদ ইবনে মা’দিকারুব, 

২১.হযরত মালিক ইবনে আউস, 

২২. হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা (رضي الله عنه)।  

    মুহাম্মদ হাসান সান্বালী (رحمة الله) (১৩০৫ হিঃ), তানসিকুন নিযাম, পৃষ্ঠাঃ ৯


রদ্দুল মোহতার গ্রন্থে বর্ণিত আছে- 

  اَدْرَكَ (ابو حنيفة) بِالسِّنّ نَحُوْ عِشْرِيْنَ صَحَابِيًا كَمَا بَسَطَ فىِ اَوَائِلِ الضِيَاءِ

ঐ গ্রন্থের আরো দুই পৃষ্ঠা পরে এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-

 هُمْ اِبْنُ نُفيل وَوَاثِلة وعبد الله بن عامر وابن اَبيِ اَوْفي وابن جُزْء وعُتبة والمِقْدَادِ وابن بُسر وابن ثَعلبَة وسَهَلْ بن سعد وأنس وعبد الرحمن بن يزيد ومحمود بن لَبِيد ومحمود بن الربيع واَبُواُمامة واُبُو الطفيل - وزادفى تنوير الصحيفة عمرو بن حُريث وعُمرو بن سَلْمَةَ وابن عَبَّاس وَسَهَلْ بن مُنيف 

ইমাম আবু হানিফা প্রায় ২০জন সাহাবীকে পেয়েছেন। তাঁরা হলেন-

১. নুফাইল, 

২. ওয়াসিলা, 

৩. আব্দুল্লাহ ইবনে আমের, 

৪. ইবনে আবি আউফা, 

৫. ইবনে জুয, 

৬.উতবা, 

৭.মিকদাদ, 

৮. ইবনে বুসর, 

৯. ইবনে সা’লাবা, 

১০. সাহল ইবেন সা’দ, 

১১. আনাস, 

১২. আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযিদ, 

১৩. মাহমুদ ইবনে লবীদ, 

১৪. মাহমুদ ইবনে রবী, 

১৫. আবু উমামা, 

১৬. আবুত তোফায়েল। তানভীরুস সহীফা গ্রন্থে আরো বৃদ্ধি করেছে-যথা, 

১৭. আমর ইবনে হুরাইছ, 

১৮. আমর ইবনে সালমা, 

১৯. ইবনে আব্বাস ও 

২০. সাহল ইবনে মুনাইফ।  

    আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬ হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ১৫৯


কোন কোন কিতাবে ইবনে ওমর (৯৬ হি.), সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (৯৪হি.) এবং ইবনে উনাইস (رضي الله عنه)কেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ হিসাব অনুযায়ী এঁদের সংখ্যা ২৩ জন হয়।


সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণনা


ইমাম আ‘যম সাহাবীদের সাথে সাক্ষাত ও দশজন সাহাবী থেকে হাদিস বর্ণনা সম্পর্কে ইমাম ইবনে বাযযার কুরদরী (رحمة الله) বলেন-

فَالْحَاصِلُ اِنَّ جَمَاعَةً مِنَ المُحَدِّثِيْنَ اَنْكَرُوا مَلَاقَاتِه الصَّحَابَةِ وَاَصْحَابُه اَثِبْتُوه بالْاَسَانِيْدِ الصِّحَاح الحِسَانِ وُهُمْ اَعْرَفُ بِاحْوالِه مِنْهُمْ وَالمُثِبْتُ العَدْلُ العَالِمُ اَوْلي النَافِي وَقَدْ اَجْمَعُوا مُسْنَدَاتِه فَبَلَغَتْ خَمْسِيْنَ حَدِيْثًا يَرْوِيه الاِمَامِ عَنِ الصَّحَابَةِ-

“মোদ্দাকথা হলো মুহাদ্দিসগণের মধ্যে একদল সাহাবীর সাথে ইমাম আ‘যমের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেন, কিন্তু তাঁর শাগরিদরা সহীহ ও হাসান সনদ দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তিনি সাহাবীদের সাক্ষাত পেয়েছেন। তাঁর শাগরিদরা অন্যান্যদের চেয়ে তাঁর সম্পর্কে অধিক অবহিত ছিলেন। কোন ন্যায়পরায়ন আলিম ব্যক্তি কোন কিছু সাব্যস্ত করলে তা অস্বীকার বা না বাচকের উপর প্রাধান্য পায়। তারা (শাগরিদরা) তাদের মুসনাদ সমূহে ইমাম আ‘যম কর্তৃক সাহাবীদের থেকে বর্ণনাকৃত পঞ্চাশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।” 

    ইমাম কুরদরী (رحمة الله) (৮২৭হিঃ), মানাকিবুল ইমাম আ‘যম আবি হানিফা খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ২০-২১ ও মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ), শরহে মুসনাদে ইমাম আ‘যম পৃষ্ঠাঃ   ২৫৮


আল্লামা আইনী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা (رضي الله عنه)’র জীবনীতে বলেন:

هُوَ اَحَدٌ مَنْ رَأه اَبُوْ حَنِيْفَةَ مِنَ الصَّحَابَةِ وَرَوَي عَنْه وَلَا يَلْتَفِتُ اِلي قَوْلِ الْمُنْكَرِ الْمَتَعَصَبِّ وَكَانَ عُمَرُ اَبِي حَنِيْفَةَ حِيْنَئِذٍ سَبَعَ سِنِيْنَ وَهُوَ سَنُّ التَّمِيْزِ هذَا عَلى الصَّحِيْحِ اِنَّ مَوْلَدَ اَبي حَنِيْفَةَ سَنَةَ ثَمَانِيْنَ وَعَلي قَوْلِ مَنْ كَانَ سِنَةَ سَبْعِيْنَ يَكُونُ عُمُره حِيْنَئِذٍ سَبَعَةَ عَشَرَ سِنَةً وَيَسْتَبَعَدُ جِدًّا اَنْ يَكُوْنَ صَحَابِي مُقِيْمًا بِبَلَدِه وَفِي اَهْلِهَا مَنْ لَا رَأَه وَاصْحَابُه اَخْبَرَ بِحَالِهِ وُهُمْ ثِقَاتٌ فِي اَنْفُسِهِمْ -

“আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা ঐ সকল সাহাবীদের একজন যাদেরকে ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (رحمة الله) দেখেছেন এবং তিনি তাঁর থেকে হাদিসও বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে পক্ষপাত অবলম্বনকারী ও অস্বীকারকারীদের মতের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। এ সময় ইমাম আ‘যমের বয়স হয়েছিল সাত বছর। কেননা বিশুদ্ধ মতানুযায়ী তিনি ৮০ হিজরীতে জন্ম লাভ করেন। অপর মতানুযায়ী তাঁর জন্ম সাল ৭০ হিজরী হলে, তখন তাঁর বয়স হবে সতের বছর। তবে সাত বছরেও বোধশক্তি ও অনুভুতি শক্তির বয়স হয়। আর এটা কিভাবে হতে পারে যে, একজন সাহাবী কোন শহরে থাকবেন আর ঐ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে এমন কে থাকবে যে তাঁকে দেখবে না? এ বিষয়ে ইমাম আ‘যমের শিষ্যগণের কথাই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কেননা, তারাই তাঁর সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত এবং গ্রহণযোগ্য।  

    আল্লামা আইনী (رحمة الله) (৮৫৫ হিঃ), উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৭৯৮)


ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) বলেন-আমি হযরত আবু হানিফা (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি ৯৩ হিজরীতে আমার পিতার সাথে হজ্জে গিয়েছি। তখন আমার বয়স ছিল ষোল বছর। আমি এক বৃদ্ধকে দেখেছি যে, তাঁর নিকট মানুষের ভীড় ছিল। আমি পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম এই ব্যক্তি কে? তিনি বললেন ইনি রাসূল (ﷺ) ’র সাহাবী এবং তাঁর নাম হলো আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে জুয। পুনরায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম তাঁর কাছে কি আছে? পিতা বললেন, তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ  ’র হাদীস আছে। আমি বললাম তাহলে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যান আমিও হাদিস শ্রবণ করবো। অতঃপর আমি মানুষের ভীড়ের মধ্যেও তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম এবং তাঁর থেকে হাদিস শুনলাম-তিনি বলতেছেন:

 قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  مَنْ تَفْقَّهَ فِيْ دِيْنِ اللهِ كَفَاهُ اللهُ وَهْمَه وَرِزْقَه مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبْه -

“রাসূল (ﷺ)  এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞানার্জন করল, আল্লাহ তাঁর জন্য যথেষ্ট এবং তিনি তাকে অগণিত রিযিক দান করবেন।”  

    কিতাবু বয়ানুল ইলম খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ৪৫, সূত্রঃ হানিফ রেজভী জামেউল আহাদীস, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠাঃ   ২৩৬

 

ইমাম আবু মা’শার আব্দুল করিম ইবনে আব্দুস সামাদ তাবারী শাফেঈ (رحمة الله) ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত হাদিস সমূহের উপর একটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন। এতে সাহাবী থেকে তাঁর বর্ণিত হাদিস সমূহ সনদসহ উল্লেখ করেছেন। আর ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী শাফেঈ (رحمة الله) ঐ সব রেওয়ায়েত সমূহ তাঁর রচিত কিতাব “তাবঈদুস সহীফা” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। 

নিন্মে এর কিছু হাদিস বর্ণিত হলো-


 عَنْ اَبِي يُوْسُفُ عَنْ اَبِي حَنِيْفَةَ سَمِعْتُ اَنَسْ بْنِ مَالِكِ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ  يَقُوْلُ طَلَبُ العِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَليَ كُلِّ مُسْلِمٍ-


১.“ইমাম আবু ইউসুফ আবু হানিফা থেকে, তিনি হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে, তিনি রাসূল (ﷺ)  থেকে  শুনেছেন, তিনি বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয।”


عَنْ اَبِي يُوْسُفُ عَنْ اَبِي حَنِيْفَةَ سَمِعْتُ اَنَسْ بْنِ مَالِكِ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ  يَقُوْلُ الدَّالُّ عَلي الخَيْرِ كَفَا عِلِه -


২. “আবু ইউসুফ আবু হানিফা থেকে, তিনি আনাস (رضي الله عنه) থেকে, তিনি রাসূল (ﷺ)  কে বলতে শুনেছেন-ভাল কাজের প্রতি পথ প্রদর্শনকারী ভাল কাজ কারীর সমান সওয়াব পাবে।”


عَنْ اَبِي يُوْسُفُ عَنْ اَبِي حَنِيْفَةَ سَمِعْتُ اَنَسْ بْنِ مَالِكِ يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ   اَنْ يُحِبَّ اللهَ اَغَاثَه اللَّهْفَانِ- 


৩. “আবু ইউসুফ ইমাম আবু হানিফা থেকে, তিনি আনাস (رضي الله عنه) থেকে, তিনি নবী করিম (ﷺ)  কে বলতে শুনেছেন-আল্লাহ তায়ালা দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করা পছন্দ করেন।”

عَنْ يَحْي بْنِ قَاسِمِ عَنْ اَبِي حَنِيْفَةَ سَمِعْتُ عَبْدَ اللهِ بْنِ اَبِى اَوْفي يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ  مَنْ بَنَي مَسْجِدًا وَلَوْ كَمُفْحَصِ قَطَّاةٍ بَنيَ اللهُ بَيْتًا فِي الجَنَّة ِ -

৪. “ইয়াহিয়া ইবনে কাসেম ইমাম আবু হানিফা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আউফা (رضي الله عنه) থেকে, তিনি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ নির্মাণ করেন যদিও সেটি কাত্তাত পাখির বাসার ন্যায় ছোটও হয়, তবুও আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।” 

    জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (رحمة الله) (৯১১হিঃ), তাবঈদুস সহীফা, পৃষ্ঠাঃ  ৬-৯


عَنْ اِسْمَاعِيْل بْنِ عَيَّاشِ عَنْ اَبِي حَنِيْفَةَ عَنْ وَاثِلَةَ بْنِ اَسْقع اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ دَعْ مَا يُرْبِيْكَ اِلي مَا لَا يُرْبِيْكَ-  

৫. “ইসমাঈল ইবনে আইয়্যাশ ইমাম আবু হানিফা থেকে, তিনি ওয়াসিলা ইবনে আসকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ)  এরশাদ করেন-সন্দেহভাজন বস্তু পরিত্যাগ কর আর ঐ বস্তু গ্রহণ কর যাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।” 

    সাওয়াঁনেহে বে বাহারে ইমাম আ‘যম, পৃষ্ঠাঃ ৬৫,সূত্র: হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকাদ্দমা, পৃষ্ঠাঃ ২৩৯

 

আল্লামা শামশুদ্দিন মুহাম্মদ আবু নসর “জাওয়াহেরুল আকাইদ ওয়া দুরারুল কালায়েদ” নামক গ্রন্থে বলেন-ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) আটজন সাহাবী থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। যেমন- 

১. আনাস, ২. জাবির, ৩. ইবনে আবি আউফা, ৪. আমের, ৫. ইবনে উনাইস, ৬. ওয়াসিলা, ৭. ইবনে জুয, ও ৮. আয়েশা বিনতে আজরাদ (رضي الله عنه)। 

    আল্লামা শামী (رحمة الله)(১৩০৬হিঃ) রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ১৫৭)


হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র অবস্থান


হাদিস শাস্ত্রের সর্বোচ্চস্থান হলো ‘হাকেম’। আর হাকেম বলা হয় ঐ মুহাদ্দিসকে যিনি রাসূল (ﷺ) ’র সব হাদিস জানেন। ইমাম আ‘যম (رحمة الله) হাদিসশাস্ত্রে ‘হাকেম’ ছিলেন। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সামায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-

 اِنَّ الِامَامَ ذَكَرَفِي تَصَانِيْفِه بِضْعِ وَسَبْعُوْنَ حَدِيْثٍ وَانْتَخَبَ الاثَارَمِنْ اَرْبَعِيْنَ اَلْفَ حَدِيْثٍ- 

“ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) স্বীয় গ্রন্থসমূহে সত্তর হাজারের অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং চল্লিশ হাজার হাদিস থেকে নির্বাচিত করে তিনি কিতাবুল আসার লিপিবদ্ধ করেছেন।” 

    মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ) মানকিব বিযাইলিল জাওয়াহের, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ   ৪৭৪

 

সদরুল আইম্মা ইমাম মুয়াফ্ফিক (رحمة الله) বলেন, 

وَاِنْتَخَبَ اَبُوُحَنِيْفَةَ الَاثَارَ مِنْ اَرْبَعِيْنَ اَلْفَ حَدِيْثٍ 

“ইমাম আবু হানিফা চল্লিশ হাজার হাদিস থেকে কিতাবুল আসার নির্বাচিত করেছেন।” 

    ইমাম মুয়াফিফক মক্কী (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ) মানাকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৯৫

 

ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ (رحمة الله)’র বর্ণনা মতে ইমাম আ‘যম আবু হানিফা (رحمة الله) যেসব হাদিস বেলা তকরার (বারংবার ছাড়া) বর্ণনা করেছেন, এর সংখ্যা চার হাজার।  

    ইমাম মুয়াফিফক মক্কী (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ) মানাকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ   ৯৬


রাসূল (ﷺ) ’র বেলা তাকরার বিশুদ্ধ হাদিসের সংখ্যা হলো সর্বমোট চার হাজার চার শত। যেমন আল্লামা আমীর ইয়ামানী (رحمة الله) লিখেছেন:

 اِنَّ جُمْلَةَ الَاحَادِيْثَ المُسْنَدِ عَنِ النَبِّي  يَعْنِي الصَّحِيْحَةَ بِلاَ تَكْرَارِ اَرْبَعَةَ الافِ وَاَرْبَعُ مِائَـةٍ -

“নিশ্চয় সমস্ত বিশুদ্ধ হাদিস যা তাকরার ব্যতীত নবী করিম (ﷺ)  থেকে বর্ণিত হয়েছে, এর সংখ্যা হলো চার হাজার চারশত।” 

    আল্লামা আমীর ইয়ামানী (رحمة الله) তাওযীহুল আফকার, পৃষ্ঠাঃ   ৬৩, সূত্র: গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ৮১

 

এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে রাসূল (ﷺ) ’র মোট হাদিসের সংখ্যা চার হাজার চারশত আর ইমাম আবু হানিফার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মাত্র চার হাজার। তাহলে তিনি কিভাবে ‘হাকেম’ হবেন? এর উত্তরে বলা হবে যে, চার হাজার হাদিস বর্ণনা করা মানে এই নয় যে, তিনি বাকী চারশত হাদিস জানেন না। কেননা, হাসান ইবনে যিয়াদের বর্ণনায় বাকী চারশত হাদিসের জ্ঞানকে নফী বা অস্বীকৃতি করা হয়নি। ইমাম আ‘যম কেবল আহকাম  বিষয়ক হাদিসগুলো তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন, যা সুনান হিসেবে প্রসিদ্ধ। হতে পারে বাকী চারশত হাদিস সুন্নাহ বা আহকাম সম্পর্কীয় ছিলনা বিধায় তিনি তা বর্ণনা করেননি। সুতরাং তিনি বর্ণনা করেননি বলে তা জানেন না একথা বলা যাবে না। যেমন ইমাম বুখারী (رحمة الله) ছয় লক্ষ হাদিস থেকে বুখারী শরীফে তাকরার ব্যতীত ইমাম আসকালানীর মতে মাত্র ২৬২৩টি মারফু হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি বাকী হাদিসগুলো জানেন না। ইবনে সালাহর মতে তাকরার হাদিস বাদ দিলে বুখারী শরীফে হাদিস হয় চার হাজার। 

তবে কেউ যদি বলে যে, ইমাম আ‘যম সত্তর হাজার হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং চল্লিশ হাজার হাদীস থেকে নির্বাচিত করে “কিতাবুল আসার” প্রণয়ন করেছেন এটি তেমন কোন উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা নয়। কেননা যেখানে ইমাম বুখারী (رحمة الله)’র একলক্ষ বিশুদ্ধ হাদিস, দুই লক্ষ অবিশুদ্ধ হাদিস মুখস্থ ছিল এবং তিনি ছয় লক্ষ হাদিস থেকে নির্বাচিত করে সহীহ বুখারী শরীফ প্রণয়ন করেন, সেখানে ইমাম বুখারীর মোকাবিলায় ইমাম আ‘যমের স্থান বহুগুণ নিচে মনে হয়। এর জবাবে বলা হবে যে, হাদিসের কম-বেশী মূলত তুরুক ও সনদের কম-বেশীর দ্বারা হয়ে থাকে। একই হাদিসের মতনকে যদি একশত ধরনের পদ্ধতি ও সনদে বর্ণনা করা হয় তখন মুহাদ্দীসগণের পরিভাষা অনুযায়ী একশত হাদীসই গণ্য করা হয়ে থাকে। অথচ ঐসব হাদিসের মতন বা মূল ইবারত একটি। 

ইমাম বুখারী (رحمة الله) ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র একশত চৌদ্দ বছর পরে জন্ম লাভ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য রাবীগণ এক একটি হাদিসকে শত সহস্র রাবীগণের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। ফলে ইমাম আ‘যম ও ইমাম বুখারীর মধ্যে হাদিসের সংখ্যার এত তফাত হয়ে গিয়েছে। এগুলোতে মূলত সনদের সংখ্যার তারতম্য হয়েছে মুল হাদিসের নয়। নতুবা মূল হাদিসের দিক দিয়ে, ইমাম বুখারী থেকে ইমাম আ‘যমের বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা অনেক বেশী।  

    আল্লাম গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৮১

 

ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ‘কিতাবুল আসার’ ইলমে হাদিসে তাঁর উচ্চ মর্যাদার ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রমাণ। এই কিতাবটি ‘ফিকহী আবওয়াব’ তথা ফিকহের অধ্যায়ে সুসজ্জিত করে লিখিত প্রথম কিতাব। ইমাম সুয়ূতী (رحمة الله) ‘তাবঈদুস সহীফা’ গ্রন্থে বলেন-ইলমে হাদীসে ইমাম আবু হানিফার অবদান ও মর্যাদা কম নয়। তিনিই সর্বপ্রথম ফিকহী বাব অনুযায়ী হাদিসের কিতাব প্রণয়ন করেছেন। এই মর্যাদায় অন্য কেউ পৌঁছতে পারেননি। এই কিতাবটিকে ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মুয়াত্তার উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। কেননা হাফেয যাহাবী (رحمة الله) মানাকিব গ্রন্থে কাযী আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবিল আওয়াম (رحمة الله)’র “আখবারে আবি হানিফা” গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে মুত্তাসিল সনদের সাথে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল আজিজ দিরাওয়ার্দী (رحمة الله)’র উক্তি বর্ণনা করেন, তা হলো,

-كان مالك ينظرفي كتب ابي حنيفة وينتفع بها 

“ইমাম মালিক (رحمة الله) ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র কিতাব সমূহ দেখতেন এবং এগুলো থেকে উপকৃত হয়েছিলেন।” এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ‘কিতাবুল আসার’ এর স্থান মুয়াত্তা ইমাম মালিকের উপরে।

আল্লামা মুয়াফিফক হাফেয আবু ইয়াহিয় যাকারিয়া ইবনে ইয়াহিয়া নিশাপুরী (رحمة الله)’র ‘মানকিবে আবি হানিফা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-

 سَمِعْتُ اَبَا حَنِيْفَةَ يَقُوْلُ عِنْدِيْ صَنَادِيْقَ مِنَ الحَدِيْثِ مَا اَخْرَجْتُ مِنْهَا اِلَّا لشَّيُ اليَسِيْر الذَّيْ يَنْتَفِع بِه – 

“আমি আবু হানিফাকে বলতে শুনেছি, আমার নিকট হাদিসের অনেক সিন্দুক রয়েছে, ওখান থেকে কেবল সহজ ও উপকৃত হওয়া যায় এমন হাদিস বের (বর্ণনা) করি।”

আল্লামা যুবাইদী (رحمة الله) ‘عقود الجواهرالمنيفه’ গ্রন্থে হাফেয আবু নঈম ইস্পাহানী (رحمة الله)’র সূত্রে ইয়াহিয়া ইবনে আবু নসর (رحمة الله)’র উদ্ধৃতি বর্ণনা করে বলেন- তিনি বলেন, আমি একদা আবু হানিফার নিকট গেলাম। তাঁর কামরা কিতাবে পূর্ণ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কিসের কিতাব? উত্তরে তিনি বলেন-এগুলো সব হাদিসের কিতাব।

    মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ), শরহে মুসনাদে ইমাম আ‘যম, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ৯

 

ইমাম সাখাবী (رحمة الله) (৯০২হি.) বলেন,

-وَالثُنَيَاتُ فِي المُوَطَّا لِلامَامِ مَالِكِ وَالوَحْدَان فِي حَدِيْثِ الِامَامِ اَبِي حَنِيْفَةَ 

“ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মুয়াত্তার হাদিস সমূহে সুনায়াত তথা দু’জনের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)  থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) মাত্র একজনের মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)  থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।” 

    ফতহুল মুগীছ, পৃষ্ঠাঃ  ২৪১, সূত্র: গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন পৃষ্ঠাঃ  ২৭৪ 

 

ইমাম বুখারী (رحمة الله) বুখারী শরীফে বর্ণিত ২২টি ‘সুলাসিয়াত’ তথা তিনজনের মাধ্যমে বর্ণিত হাদিসের মধ্যে ১১টি হাদিস ইমাম আ‘যমের ছাত্র মক্কী ইবনে ইব্রাহীম থেকেই বর্ণনা করেছেন। আর এই মক্কী ইবনে ইব্রাহীম সম্পর্কে আল্লামা মুয়াফিফক (رحمة الله) বলেন- 

وَلَزِمَ اَبَا حَنِيْفَةَ رَحِمَةُ اللهُ وَسَعَ مِنْهُ الحَدِيْثَ“

তিনি নিজের উপর হাদিস শ্রবণের জন্য ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে আবশ্যক করে নিয়েছিলেন।”  

    ইমাম মুয়াফিফক (৫৬৮হিঃ), মানকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ ২০৩

 

এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম বুখারী উত্তম সনদের সাথে ‘সুলাসিয়াত’ হাদিস অর্জনের যে মর্যাদা লাভ করেছেন তা ইমাম আ‘যমের ছাত্রের বদৌলতে সম্ভব হয়েছে। শুধু তা নয় বরং যে সকল (নির্ভরযোগ্য) শায়খগণের মাধ্যমে সিহাহ সিত্তাহর ভিত্তি হয়েছে তাদের অধিকাংশ হযরত আবু হানিফা (رحمة الله)’র ইলমে হাদিসে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ এ শিষ্য।  

➥      গোলাম রাসূল সাঈদী, তাযকেরাতুল মুহাদ্দিসীন, উর্দু,পৃষ্ঠাঃ  ৮৪


ইমাম আব্দুল ওহাব শা’রানী (رحمة الله) মাসানীদে ইমাম আ‘যমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেন-

 وَقَدْ مَنَّ اللهُ عَليَ بِمُطَا لِعَةِ مَسَانِيْدِ اللاِمَام اَبِي حَنِيْفَةَ الثَلَاثَةَ فرأيته لا يروي حديثا الا عن اخبار التابعين العدول الثقات الذين هم من خير القرون بشها دة رسول الله صلي الله عليه وسلم كا لا سودو علقمة وعطاء وعكرمه ومجاهد ومكهول والحسن البصري واضرابهم رضي الله عنهم اجمعين فكل الرواة الذين هم بينه وبين رسول الله صلي الله عليه وسلم عدول ثقات اعلام اخيار ليس فيهم كذاب ولا متهم بكذب

“আল্লাহ তায়ালা আমার উপর দয়া করেছেন যে, আমি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র তিনটি মাসানিদ অধ্যয়ন করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি দেখেছি যে, তিনি সিকা ও সাদিক তাবেঈগণ ব্যতীত অন্য কারো থেকে রেওয়ায়েত করেননি, যাদের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ)  “খায়রুল কুরুন” তথা উত্তম যুগের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন, আসওয়াদ, আলকামা, আতা, ইকরামা, মুজাহিদ, মাকহুল ও হাসান বসরী এবং এদের ন্যায় আরো অনেক থেকে রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম আ‘যম ও রাসূল (ﷺ) ’র মধ্যখানে সকল বর্ণনাকারী আদেল, সিকাহ এবং প্রসিদ্ধ সৎলোক ছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ মিথ্যুক এ কথা কল্পনাও করা যাবে না।”  

    ইমাম আব্দুল ওহাব শা’রানী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ)  মীযানুশ শরীয়তুল কুবরা, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৬৮


ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র ইলমে হাদিস সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত ওলামায়ে কিরামের অভিমতঃ


 قال خلف بن ايوب صار العلم من الله تبارك وتعالي الي محمد صلي الله عليه وسلم ثم صار الي التابعين ثم صار الي ابي حنيفة واصحابه شاء فليرض ومن شاء فليسخط“

খালফ ইবনে আউয়ুব বলেন-আল্লাহ তায়ালা থেকে ইলম রাসূল (ﷺ)  পেয়েছেন, তাঁর থেকে তাঁর সাহবীগণ, তাঁদের থেকে তাবেঈগণ, তাঁদের থেকে পেয়েছেন ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর শাগরীদগণ। অতএব এতে কেউ সন্তুষ্ট হোক অথবা অসন্তুষ্ট হোক, সত্যি হলো এটাই।  

    খতীব বাগদাদী (৪৬৩হিঃ), তারিখে বাগদাদ, খন্ড ১৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৩৬

 

মুহাদ্দিস সালেহীন (رحمة الله) বলেন,-“ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) একজন শ্রেষ্ঠ হাফিযে হাদিস ও শীর্ষ স্থানীয় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি যদি হাদিস মুখস্থ করতে গভীর মনোনীবেশ না দিতেন তবে এত অধিক ফিকহী মাসয়ালা বের করতে পারতেন না।” 

➥  আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৮ 

 

আল্লামা হাফিয যাহাবী বলেন, “ইমাম আবু হানিফার (رحمة الله) যদিও হিফযে হাদিসের বিরাট অধিকারী ছিলেন তথাপিও তাঁর থেকে কম হাদীসই বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ শুধু এই ছিল যে, তিনি হাদিস রিওয়ায়েতের পরিবর্তে হাদিস থেকে ফিকহী মাসাইল উদ্ভাবনে সর্বদা মশগুল ছিলেন।”    

    তাযকারাতুল হুফফায, সূত্র: আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা,

 

শায়খুল ইসলাম ইয়াযিদ ইবনে হারূন (رحمة الله) বলেন, 

كان ابو حنيفة تقيا ونقيا زاهدا عابدا عالما صدوق اللسان احفظ اهل زمانه 

“ইমাম আবু হানিফা অত্যন্ত মুত্তাকী, পরিছন্ন গুণের অধিকারী মহাসাধক, আবিদ, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িক কালের হাদিসের সর্বাপেক্ষা হাফেযে হাদিস ছিলেন।” 

    মানাকিবে আবু হানিফা, সূত্র: আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা,

 

ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান (رحمة الله) বলেন,

 انه والله لاعلم هذه الامة بما جاء عن الله وعن رسوله 

“আল্লাহর শপথ! আবু হানিফা (رحمة الله) বর্তমান মুসলিম উম্মাহের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশী বিজ্ঞ।”  

    কিতাবুত তালীম, সূত্রঃ আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা,

 

মুহাদ্দিস ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন (رحمة الله) কে ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন,

 ثقة مأمون ما سمعت احداضعفه 

“তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত ভুল-ভ্রান্তিমুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। হাদিসের বিষয়ে কেউ তাঁকে দুর্বল বলেছেন বলে আমি শুনিনি।”  

    আল্লামা আইনী (رحمة الله) (৮৫৫হিঃ) উমদাতুল ক্বারী, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ ১২, সূত্র: আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৯

 

ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন (رحمة الله) আরো বলেন,

 كان ابو حنيفة ثقةً لا يحدث الا بما يحفظه ولايحدث بمالا يحفظ

“ইমাম আবু হানিফা নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি নিজের মুখস্থ ও সুরক্ষিত হাদিসই বর্ণনা করতেন। যা তাঁর মুখস্থ নেই তা তিনি কখনো বর্ণনা করতেন না। 

➥      ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) (৮৫২হিঃ) তাহযীবুত তাহযীব, সূত্র, আল উকুদুল জিনান, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা,

 

হাফস ইবনে গিয়াস (رحمة الله) বলেন “ইমাম আবু হানিফার ন্যায় ঐসব হাদিসের আলিম দেখিনি যেগুলো আহকামের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ ও উপকৃত।” 

➥      হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, উর্দু, মুকাদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ  ২৬০ 

 

আবু আলকামা (رحمة الله) বলেন-“আমি আমার শায়খগণ থেকে শ্রবন কৃত হাদিস সমূহ ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র নিকট পেশ করেছি অর্থাৎ শুনিয়েছি। তিনি প্রত্যেক হাদিসের জরুরী বিষয় বর্ণনা করেছেন। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যে, কেন আমি তাঁকে সব হাদিস শুনায়নি?  

    হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, উর্দু, মুকাদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ  ২৬০

 

ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) বলেন-আমি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র চেয়ে হাদিসের অর্থ এবং ফিকহী রহস্য সম্পর্কে বেশী জ্ঞাত কাউকে দেখিনি। যে মাসয়ালায় চিন্তা গবেষণা করতেন তাতে ইমাম আ‘যমের দৃষ্টিভঙ্গী পরকালের মুক্তির দিকেই বেশী থাকত। আমি তাঁর জন্য আমার পিতার পূর্বে দোয়া করি।  

    হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, উর্দু, মুকাদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ  ২৬০


হাফিয মুহাম্মদ ইবনে মাইমুন (رحمة الله) বলেন- ইমাম আ‘যম (رحمة الله)’র সময়কালে তাঁর চেয়ে বড় কোন আলিম, পরহেযগার, কোন যাহিদ, কোন আরিফ, ও কোন ফকীহ ছিলনা। খোদার শপথ! আমার কাছে লক্ষ আশরাফীও এত মূল্যবান ছিলনা, যে পরিমান খুশী হই তার থেকে হাদীস শুনে।  

    ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৭৯, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৮২

 

হযরত মিসআর ইবনে কুদাম (رحمة الله) বলেন,

 طلبنا مع ابي حنيفة الحديث فغلبنا فأخذ نا في الزهد فبرع علينا وطلبنا معه الفقه فجاء منه ماترون 

“আমরা আবু হানিফার সাথে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করতাম, অতঃপর তিনি আমাদের উপর হাদিস শিক্ষায় বিজয়ী হলেন। অতঃপর পরহেযগারীতে ও তিনি আমাদের উপর প্রাধান্যতা লাভ করলেন, আর তাঁর সাথে ফিকহ শিক্ষার্জন করলাম এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান তো তোমরা দেখতেছ।  

    উকুদুল জিনান, পৃষ্ঠাঃ ১৯৬

 

ইলমে ফিকহ ও অন্যান্য বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের অভিমত

ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) বলেনঃ

 الناس في الفقه عيال علي ابي حنيفة 

“ইলমে ফিকহে প্রতিটি মানুষ ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র পরিবারভুক্ত।”  

    তাযকিরতুল হুফফায পৃষ্ঠাঃ ১৬০, সূত্রঃ ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন বাইফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৫

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله) বলেন- “ইমাম আবু হানিফা হলেন জ্ঞানের খাটি নির্যাস।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ) আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু পৃষ্ঠাঃ  ৭১, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৪

 

ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) আরো বলেন-“কোন ব্যক্তি যদি ইলমে ফিকহে পূর্ণতা অর্জন করতে চায়, সে যেন আবু হানিফা (رحمة الله)’র পরিবার ভুক্ত হয়ে যায়। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদের জন্য ইলমে ফিকহ সহজ করে দেওয়া হয়েছে।”  

    প্রাগুক্ত পৃষ্ঠাঃ ৭১, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৭৪

 

ইমাম আ‘মাশ (رحمة الله) বলেন-নিঃসন্দেহে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) একজন মহান ফকীহ।” 

    আবু যুহরা মিসরী, আবু হানিফা হায়াতুহু ফিকহুহু, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৮


মক্কী ইবনে ইব্রাহীম (رحمة الله) বলেন-ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তাঁর জ্ঞান থেকে সে ব্যক্তি বিমূখ হতে পারে, যে তাঁকে বুঝতে পারেনি।  

 ➥     আবু যুহরা মিসরী, আবু হানিফা হায়াতুহু ফিকহুহু, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন

 

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে জুরাইজ (رحمة الله) বলেন-“জ্ঞানে তিনি সুউচ্চ মকাম দখল করে নিয়েছেন। তিনি উচ্চস্বরে বলতেন-আবু হানিফা একজন মহান ফকীহ, একজন মহান ফকীহ।”  

    আবু যুহরা মিসরী, আবু হানিফা হায়াতুহু ফিকহুহু, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন

 

বিখ্যাত মুহাদ্দিস কায়েস ইবনে রাবী (رحمة الله) বলেন-كان ابو حنيفة اعلم الناس بما لم يكن “যে সকল মাসয়ালা সংঘটিতব্য সেগুলো সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) সর্বাদিক জ্ঞান রাখতেন।”  

    ইমাম মুয়াফিফক মক্কী (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ) মানাকিবুল ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) সূত্র: প্রাগুক্ত


“সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (رحمة الله) বলেন-আবু হানিফা সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন। আমার চোখে তাঁর দৃষ্টান্ত দেখেনি।” 

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা পৃষ্ঠাঃ ২৫৯


ইস্রাঈল ইবনে ইউনুস (رحمة الله) বলেন-“বর্তমান যুগে লোক যেসব বস্তুর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) ঐগুলোকে সবচেয়ে বেশী জানতেন।”  

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা পৃষ্ঠাঃ ২৫৯

 

ইবনে মসউদ (رضي الله عنه)’র পৌত্র হযরত কাসেম (رحمة الله) বলেন, “ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মজলিসের চেয়ে বেশী ফয়েজ পৌঁছানো কোন মজলিস নেই।”  

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা পৃষ্ঠাঃ ২৫৯

 

মিসআর ইবনে কুদাম (رحمة الله) বলেন-“আমার কাছে মাত্র দু’ ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা হয়। আবু হানিফার উপর তাঁর ফিকহের কারণে আর হাসান ইবনে সালেহর উপর তাঁর তাকওয়া পরহেযগারীর উপর।”  

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা পৃষ্ঠাঃ ২৬০

 

দাউদ তাঈ (رحمة الله) বলেন-“যে ব্যক্তির ইলম ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ইলম জাতীয় হবেনা, ঐ ইলম সাহেবে ইলমের জন্য আপদ হবে।”  

➥      মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা পৃষ্ঠাঃ ২৬০

 

ফুযাইল ইবনে আইয়্যায (رحمة الله) বলেন-“আবু হানিফা (رحمة الله) একজন ফকীহ ছিলেন এবং ফিকহ বিষয়ে অধিক প্রসিদ্ধ লাভ করেছেন। তাঁর রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিক্রম হতো, কথা কম বলতেন। তবে যখন হালাল-হারামের মাসয়ালা আসতো তখন হক ও সঠিক মাসয়ালাই বলতেন। বিশুদ্ধ হাদিস হলে অনুসরণ করতেন চাই তা সাহাবীর হোক কিংবা তাবেঈর হোক। নতুবা কিয়াস করতেন এবং খুবই উত্তম কিয়াস করতেন।”  

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ ২৬১

 

আব্দুর রাজ্জাক ইবনে হুম্মাম (رحمة الله) বলেন- “আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বেশী ইলম ওয়ালা ব্যক্তি কখনো দেখিনি।”  

➥      মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ ২৬১


আলী ইবনে হাশেম বলেন-“আবু হানিফা (رحمة الله) ইলমের ‘খযিনা’ ছিলেন। যে মাসয়ালা বড়দের কাছেও কঠিন ও মশকিল হতো তাঁর জন্য খুবই সহজ ছিল।”  

    মাওলানা হানিফ রেজভী, জামেউল আহাদীস, মুকদ্দামা, পৃষ্ঠাঃ ২৬১

 

ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ কাত্তান (رحمة الله) বলেন- “আবু হানিফা (رحمة الله)’র সিদ্ধান্তের চেয়ে আমি আর কারো সিদ্ধান্ত উত্তম পাইনি। এ জন্য আমি ফাতওয়ায় তাঁর মতই গ্রহণ করি।  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু পৃষ্ঠাঃ  ৭৫

 

ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) বলেন- আমি কাউকে আবু হানিফার (رحمة الله) থেকে বড় ফকীহ মনে করিনা এবং আমি এমন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করিনি যিনি তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ। যে ব্যক্তি তাঁর কিতাব গুলোর অধ্যয়ন করবে না সে ফকীহ হবেনা এবং জ্ঞানের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ   ৭১, আরবী পৃষ্ঠাঃ  ৭৪

 

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা বলেন- “কেউ ইলমে মাগাযী অর্জন করতে চাইলে মদীনা যাবে, মানাসিক বা হজ্জের জ্ঞানার্জনের জন্য মক্কা যাবে আর ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য কূফায় যাবে এবং ইমাম আবু হানিফার (رحمة الله)’র শিষ্যদের সাহচর্যে বসবে।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ   ৭১, আরবী পৃষ্ঠাঃ  ৭৪


আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله) একদা হাদিস লিখছিলেন এবং বললেন- حدثني النعمان بن ثابت “আমাকে নু’মান ইবনে সাবিত হাদিস বর্ণনা করেছেন।” উপস্থিত একজন বলল-কোন নু’মান? তিনি বললেন আবু হানিফা যিনি জ্ঞানের মগজ। তখন কেউ কেউ হাদিস লিখা থেকে বিরত রইল। তিনি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন-হে লোকেরা! তোমরা আইম্মাগণের সাথে কতটুকু বিয়াদবী এবং তাঁদের সম্পর্কে কতটুকু অজ্ঞ আছ, তোমাদের নিকট ইলম ও ওলামাদের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই। কোন ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা থেকে অধিক অনুসরণ যোগ্য নয়। তিনি ইমাম, মুত্তাকী, পরহেযগার, আলিম ও ফকীহ ছিলেন। তিনি ইলমকে এমনভাবে খোলাসা করতেন কেউ স্বীয় মেধা দিয়ে এভাবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে পারেন নি। তারপর তিনি শপথ করলেন যে, একমাস যাবৎ তাদেরকে আর হাদিস বর্ণনা করবেন না।  

➥  ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু পৃষ্ঠাঃ ৭১, আরবী পৃষ্ঠাঃ  ৭৫

  

কোন এক ব্যক্তি সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله) কে বলল-আমি ইমাম আবু হানিফার (رحمة الله)’র কাছ থেকে আসতেছি। তিনি বলেন খোদার কসম। তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফকীহর কাছ থেকে আসতেছ। তারপর বললেন-যে ইমাম আবু হানিফার বিরোধীতা করবে তার উচিত যে, সে আগে যেন ইমাম সাহেব থেকে উঁচু মর্যাদা অর্জন করে নেয়। আর এরূপ হওয়া অসম্ভব। যখন সুুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আবু হানিফা হজ্জে গেলেন তখন ইমাম আবু হানিফাকে সামনে রাখতেন আর সুফিয়ান সাওরী তাঁর পিছনে পিছনে চলতেন। কেউ যদি তাঁদের থেকে কোন মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করতো তখন ইমাম সাহেবই উত্তর দিতেন। সুফিয়ান সাওরীর মাথার দিকে ইমাম সাহেবের ‘কিতাবুর রিহন’ রাখতেন। কেউ জিজ্ঞাসা করল আপনি কি ইমাম আ‘যমের কিতাব দেখেন? তিনি বললেন, এটি আমার অন্তরে বিদ্যমান। যদি তাঁর সব কিতাব আমার কাছে থাকতো এবং আমি অধ্যয়ন করতে পারতাম, তবে জ্ঞানের ব্যাখ্যায় কোন কথা বাদ পড়তোনা। কিন্তু তোমরা ইনসাফ কর না। ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) বলেন-সুফিয়ান সাওরী আমার চেয়ে বেশী ইমাম আ‘যমের অনুসরণ করেন।  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ ৭২, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৭৬

 

একদা সুফিয়ান সওরীর কাছে কেউ প্রশ্ন করল, আপনার কাছে কি ইমাম মালিকের সিদ্ধান্তের উপর ইমাম আবু হানিফার সিদ্ধান্ত অধিক পছন্দনীয়? উত্তরে তিনি বললেন-মুয়াত্তা ইমাম মালিক থেকে লিখে নাও, তিনি রাবীদের ব্যাপারে যাচাই বাচাই করেন আর ফিকহ ইমাম আবু হানিফা এবং তাঁর শাগরিদদের অধিকার। যেন তাদেরকে এ কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৪, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৭৭


খতীব বাগদাদী কোন কোন মুত্তাকী ইমাম থেকে বর্ণনা করেন যে, “সকল মুসলমানের উপর ওয়াজিব হলো ইমাম আবু হানিফার জন্য নামাযে দোয়া করা। কেননা, তিনি হাদিস ও ফিকহকে সংরক্ষন করেছেন। অনেকেই হিংসা ও অজ্ঞতার কারণে তাঁর ব্যাপারে সমালোচনা করেছে। কিন্তু তিনি আমার নিকট খুবই উত্তম। যে ব্যক্তি গোমরাহী ও অজ্ঞতার লজ্জা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং ফিকহের স্বাদ পেতে চায়, সে যেন ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র কিতাব অধ্যয়ন করে।”  

➥      ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,, পৃষ্ঠাঃ ৭৪

 

নদ্বর ইবনে সুমাইল বলেন- “লোক ফিকহ সম্পর্কে অনবহিত এবং ঘুমন্ত ছিল। ইমাম আবু হানিফাই ফিকহ’র বর্ণনা স্পষ্ট এবং খোলাসা করে তাদেরকে জাগ্রত করেছেন।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৫, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৮


মিস’আর ইবনে কুদাম (رحمة الله) বলেন- “যে ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে নিজের এবং আল্লাহর মাঝে মধ্যস্থতা বানায়, তবে আমি আশা রাখি যে, তার কোন ভয় থাকবে না এবং সে সতর্কতায় ঘাটতি করেনি। কেউ তাকে বলল, আপনি অন্য কারো মত ত্যাগ করে সর্বদা ইমাম আবু হানিফার মত গ্রহণ করেন কেন? উত্তরে তিনি বলেন-তাঁর মত বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে। তাঁর মতের চেয়ে উত্তম মত আন, আমি তাঁর মত থেকে ফিরে আসবো।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,পৃষ্ঠাঃ  ৭৫, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৮

 

ঈসা ইবনে ইউনুছ বলেন-“কোন ব্যক্তি যদি ইমাম আবু হানিফার শানে বেয়াদবী করে, তোমরা অবশ্যই তার কথা বিশ্বাস করবেনা। খোদার কসম! আমি কাউকে তাঁর থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ ফকীহ দেখিনি।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৫, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৮

 

ইমাম আ’মশ (رحمة الله) কে একটি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন- “এর উত্তম জবাব দিতে পারবে ইমাম আবু হানিফা। আমার বিশ্বাস যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইলমে বরকত দিয়েছেন।”  

➥      ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ ৭৬, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৯

 

ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (رحمة الله) বলেন-“আমি ইমাম সাহেব থেকে কোন বড় ফকীহ এবং উত্তম ভাবে নামায আদায়কারী দেখিনি।”  

➥      ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ৭৭, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮০

 

হাফিয ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন (رحمة الله) বলেন-“চারজন ব্যক্তি হলেন ফকীহ। ১.ইমাম আবু হানিফা, ২.সুফিয়ান, ৩.মালিক ও ৪.আওযাঈ। আমার মতে হামযার কিরাতই প্রকৃত কিরাত আর ইমাম আবু হানিফার ফিকহ-ই হলো প্রকৃত ফিকহ। লোকেরাও তা মনে করে। কেউ তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, সুফিয়ান সওরী কি ইমাম আবু হানিফা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন-হ্যাঁ, তিনি ‘সিকাহ’ ছিলেন এবং ফিকহ ও হাদিসে বিশ্বস্ত ছিলেন, আল্লাহর দ্বীনের আমানতদার ছিলেন।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৭৭, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮১


হাফিয আব্দুল আযিয ইবনে আবি রাওয়াদ বলেন, যে ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফাকে ভালবাসে সে সুন্নী এবং সে তাঁর শত্রুতা পোষণ করে সে বদমাযহাবী।  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৭১, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮১ 

 

ইমাম ইব্রাহীম ইবনে মুয়াবিয়া দ্বারীর বলেন-“ইমাম আবু হানিফার ভালবাসা পোষণ করা দ্বীনের পূর্ণতা ও সুন্নত। তিনি ন্যায়পরায়নের প্রশংসা করতেন এবং ন্যায় ও যুক্তিসংগত কথা বলতেন। তিনি লোকের জন্য ইলমের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং এর মুশকিলাতকে সহজ করে দিয়েছেন।”  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৯, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮২

 

আসাদ ইবনে হাকীম বলেন- “কেবল জাহিল-অজ্ঞ লোকেরাই আবু হানিফার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে।”  

➥      ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৯, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮২

 

আবু সোলায়মান বলেন-“ইমাম আবু হানিফা এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কথায় ঐ ব্যক্তিই কটুক্তি করতে পারে, যে তাঁর কথা বুঝার যোগ্যতা রাখেনা।”  

➥      ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠাঃ  ৭৯, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮২

 

ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) বলেন-“একদা ইমাম মালিক (رحمة الله) কে কেউ প্রশ্ন করল যে, আপনি ইমাম আবু হানিফাকে দেখেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, হ্যাঁ। আমি তাঁকে এমন ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি যে, যদি তিনি এই খুঁটিকে স্বর্ণ সাব্যস্ত করতে চান, তবে স্বীয় ইলম দ্বারা এরূপ করতে পারেন।” 

    খতীব বাগদাদী (رحمة الله) (৪৬৩হিঃ), তারীখে বাগদাদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ৩৩৮

 

ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) বলেন,

 اني لا تبرك بابي حنيفة واجئ الي قبره فاذا عرضت لي حاجة صليت ركعتين وسئلت الله تعالي عند قبره فتقضي سريعا وذكر بعض من كتب علي المناهج ان الشافعي صلي الصبح عند قبره فلم يقنت فقيل له لم قال تأ د با مع صاحب هذا القبر 

“আমি ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে বরকত হাসিল করি এবং তাঁর কবরে যেতাম। যখন আমার কোন প্রয়োজন বা সমস্যা হতো আমি দু’রাকাআত নামায পড়তাম এবং তাঁর কবরের নিকট আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। ফলে দ্রুত সমস্য সমাধান হয়ে যেত। কেউ কেউ বলেছেন-ইমাম শাফেঈ (رحمة الله) ইমাম আ‘যমের কবরের পাশে ফজরের নামায আদায় করেন এবং দোয়া কুনুত পড়েননি। কেউ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন-এই কবরওয়ালার সম্মানার্থে।”  

➥      আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৪

 

ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ইলমে ফিকহের প্রবর্তক


ইসলামে যে চারটি মাযহাব প্রচলিত আছে এর মধ্যে হানাফী মাযহাব বা ফিকহে হানাফীই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। ইমাম আ‘যম আবু হানিফা নু’মান ইবনে সাবিত (رحمة الله) হলেন এ মাযহাবের প্রবর্তক। তাঁর নামানুসারে এ মাযহাবের নামকরণ করা হয় ‘হানাফী মাযহাব’ বা ‘ফিকহে হানাফী’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের নিকট এ মাযহাবই সর্বাধিক সমাদৃত। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন-

 احنفية ثلثي المؤمنين 

“বর্তমান দুনিয়ার এক তৃতীয়াংশ মু‘মিন হানাফী মাযহাবের অনুসারী।” 

    মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) (১০১৪হিঃ), মিরকাত, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ ২৪

 

ফিকহে হানাফী সারা বিশ্বে এত সমাদৃত লাভ করার কারণ বর্ণনা করে শাফেঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারী শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা কিরমানী (رحمة الله) বলেন,

فلولم يكن لله سر خفي فيه لما جمع له شطر الاسلام وما ينقاد به علي تقليده حتي عبد الله بفقهه وعمل برائه الي يومنا وفيه اول دليل علي صحته

“ফিকহে হানাফীতে যদি মহান আল্লাহর গোপন রহস্য নিহিত না থাকত, তাহলে ইসলামের অর্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত বিপুল সমাবেশ তাতে ঘটত না এবং এত বিপুল সংখ্যক লোক তাঁর অনুসরণ করত না। এমনকি আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (رحمة الله)তাঁর ফিকহ গ্রহণ করতেন না এবং আজ পর্যন্ত মানুষ তাঁর ফিকহ ও সিদ্ধান্তের উপর আমল করে আসছে। এটাই তাঁর মাযহাবের বিশুদ্ধতার প্রধান প্রমাণ।” 

    আল মুগনা, পৃষ্ঠাঃ ৮০, সূত্র: ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন বাইফা, পৃষ্ঠাঃ  ১৯৯

 

উপরোক্ত অভিমত হিজরী দশম শতাব্দীর। এরপর আরো কয়েকশত শতাব্দী অতীত হয়েছে এবং মুসলমানদের সংখ্যাও বেড়েছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলামনদের প্রায় অর্ধেকই হানাফী মাযহাবের অনুসারী ও অনুরাগী। 

    ফিকহে হানাফীর ইতিহাস ও দর্শন, বাইফা পৃষ্ঠাঃ  ১৯৯

 

এ প্রসিদ্ধ ও বিশাল মাযহাবের প্রবর্তক যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুয়াফিফক (رحمة الله) বলেন:

  وابو حنيفة رحمه الله اول من دون علم هذه الشريعة لم يسبقه احد ممن قبله 

“ইমাম আবু হানিফাই সর্ব প্রথম এই শরিয়তের ইলম তথা ইলমে ফিকহ সংকলন করেন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীহদের কেউ তাঁকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়নি।” 

➥      ইমাম মুয়াফিফক (رحمة الله) (৫৬৮হিঃ), মানকিবুল ইমাম আবু হানিফা, খন্ড২, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৬


আল্লামা সুয়ূতী শাফেঈ (رحمة الله) (৯১১হি.) বলেন-

انه اول من دون علم الشريعة ورتبها ابوابا ثم تبعه مالك بن انس ولم يسبق ابا حنيفة احد 

“ইমাম আবু হানিফাই সর্বপ্রথম এই শরীয়ত তথা ইলমে ফিকহ সংকলন করেন এবং তা অধ্যায় হিসাবে বিন্যস্ত করেন। তারপর এ পথে তাঁর অনুসরণ করেন ইমাম মালিক ইবনে আনাস (رحمة الله)। ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে কেউ এ বিষয়ে পেছনে ফেলতে পারেনি।” 

    আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (رحمة الله) (৯১১হিঃ), তাবঈদুস সহীফা,পৃষ্ঠাঃ  ৩৬

 

আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী শাফেঈ (رحمة الله) বলেন,

-انه اول من دون علم الفقه ورتبه ابوابا وكتب علي نحو ما هوعليه اليوم 

“ইমাম আবু হানিফাই সর্বপ্রথম ইলমে ফিকহ সংকলন করেন এবং একে অধ্যায় হিসাবে বিন্যস্ত করেন। আর বর্তমানে ফিক্হ যেভাবে আছে সেভাবে তিনিই তা লেখার ব্যবস্থা করেন। 

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, আরবী, পৃষ্ঠাঃ ৭৩

 

ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমূহ সমস্যার সমাধান কল্পে দীর্ঘ ২২ বছরকাল পর্যন্ত সাধনা করেন এবং তাঁর সুযোগ্য ও বিশিষ্ট ছাত্রদের নিয়ে চল্লিশ সদস্যের একটি ফিকহী বোর্ড গঠন করে কুরআন, হাদিস, ইজমায়ে সাহাবা, ফাতাওয়ায়ে সাহাবা এবং কিয়াসের মাধ্যমে ব্যাপক গবেষণা করে বিষয় ভিত্তিকভাবে ফিকহের এক বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেন যা ‘ইলমে ফিকহ’ নামে পরিচিতি ও সুবিদিত। সুদীর্ঘ ২২ বছর দিবারাত্রির পরিশ্রম ও সাধনা-গবেষণার পর ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র এ ফিকহ সম্পাদনা পরিষদের মাধ্যমে ‘মাজমুয়ায়ে ফিকহ’ তৈরি হয়ে আলিমদের হাতে পৌঁছে। এ মজমুয়ায় তিরাশি হাজার মাসয়ালা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে আটত্রিশ হাজার ইবাদত সম্পর্কীয়, এবং পঁয়তালি­শ হাজার পরস্পর লেনদেন, চুক্তি ও শান্তি সম্পর্কিত ছিল। তিনি একাজ আরম্ভ করেছিলেন ১২১ হিজরীতে এবং ১৪৪ হিজরীর পূর্বেই তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু এরপরও এতে মাসয়ালা সংযোজন হতে থাকে। অবশেষে ফিকহে হানাফীর মাসয়ালা সংখ্যা পাঁচ লক্ষে গিয়ে পৌঁছাল। আল্লামা খাওয়ারেযমী (رحمة الله) জামেউল মাসাইল গ্রন্থে বলেন,

-وقد قيل بلغت مسائل ابي حنيفة خمسمأة الف مسألة كتبه وكتب اصحابه تدل علي ذالك 

“বলা হয় যে, ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র লিপিবদ্ধ মাসাইলের সংখ্যা পাঁচ লক্ষে পৌঁছেছে। তাঁর ও তাঁর ছাত্রদের গ্রন্থরাজিই এর প্রমাণ বহন করে।” 

    আল্লামা খাওয়ারেযমী (رحمة الله) জামেউল মাসাইল, পৃষ্ঠাঃ  ৩৫

 

ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ‘ইলমে ফিকহ’ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করে সারা বিশ্বময় সুখ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ‘ফিকহ’গণ মানুষের সার্বিক চাহিদা পূরণ করে মানুষের ঈমান-আকীদা, আমল-আখলাক, কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালত, তথা জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে অনন্য খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে।

রদ্দুল মোহতার গ্রন্থে বলা হয়েছে-

 والحاصل ان ابا حنيفية النعمان من اعظم معجزات المصطفي بعد القران وحسبك من مناقبه اشتهار مذهبه ما قال قولا الا اخذ به امام الائمة الاعلام وقد جعل الحكم لاصحابه واتباعه من زمنه الي هذه الايام الي ان يحكم بمذ هبه عيسي عليه السلام وهذا يدل علي امرعظيم - 

“মোদ্দাকথা হলো নিশ্চয় আবু হানিফা নু‘মান পবিত্র কুরআনের পর রাসূল (ﷺ)  সবচেয়ে বড় মু’জিযা। তাঁর ফযীলতের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তাঁর মাযহাব এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেক বড় বড় ইমামগণও তাঁর মাযহাব গ্রহণ করেছেন এবং তৎকাল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর শিষ্য ও অনুসারীরাই ফায়সালা ও বিচার কার্য আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। এমনকি হযরত ঈসা (عليه السلام) পৃথিবীতে আগমন করে ইমাম আ‘যমের মাযহাব মোতাবেক ফায়সালা করবেন। এটি এই মাযহাবের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বড় দলীল। 

    আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৬

 

উক্ত গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে যে, নিশ্চয় ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মাযহাব অনেক আউলিয়া কিরাম অনুসরণ করেছেন। যেমন-ইব্রাহীম ইবনে আদহাম, শকীক বলখী, মারূফ কারখী, বায়েজীদ বোস্তামী, ফুযাইল ইবনে আয়ায, দাউদ তাঈ, আবু হামেদ লাফফাক, খালাফ ইবনে আইয়ুব, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ, আবু বকর ওয়াররাক প্রমুখ পদের সংখ্যা অগণিত। তাঁরা যদি এই মাযহাবে কোন সন্দেহভাজন কিছু পেতেন কখনই তারা এর অনুসরণ, অনুকরণ ও সমর্থন করতেন না।  

➥  আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১৩৬


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র ইবাদত ও রিয়াযত


আল্লামা যাহাবী (رحمة الله) বলেন, তাঁর রাতের তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য দাঁড়ানো এবং ইবাদত করা মুতাওয়াতির বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত আছে। বরং ত্রিশ বছর যাবৎ সারা রাত ইবাদত করতেন এবং এক এক রাকাতে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করেছেন এবং যে স্থানে তিনি ইন্তেকাল করেছেন সে স্থানে সত্তর হাজার বার কুরআন শরীফ খতম করেছেন।  

 ➥    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ৮১, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮৪

  

ইমাম আবু ইউসুফ (رحمة الله) বলেন-তিনি প্রতি রাতে ও দিনে এক খতম করে কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং রমযান মাসে ঈদের দিন পর্যন্ত মোট বাষট্টি খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি দানবীর ছিলেন, শিক্ষাদানে বড় ধৈর্যশীল ছিলেন।তাঁকে যা কিছু বলা হতো তিনি ধৈর্য্যধারণ করতেন, রাগ হতেন না কখনো। আমি তাঁকে বিশ বছর যাবত দেখেছি যে, তিনি রাতের প্রথমাংশে উযূ করতেন ঐ উযূ দিয়ে ফজরের নামায আদায় করেছেন। আর যারা আমার পূর্বে তাঁর খেদমতে ছিলেন তারা বলেন চল্লিশ বছর থেকে তাঁর অবস্থা এরূপ।  

    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৮২, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮৫


মিসআর (رحمة الله) বলেন-“আমি তাঁকে দেখলাম যে, ফজরের নামায পড়ে ছাত্রদেরকে শিক্ষাদানের জন্য বসতেন তারপর যোহরের নামায পড়ে পুনরায় আসর পর্যন্ত বসতেন। তারপর আসরের পর মাগরীব পর্যন্ত, মাগরীবের পর এশা পর্যন্ত শিক্ষাদান করতেন।

আমি মনে মনে বললাম-তিনি সারাদিন বিদ্যা শিক্ষায় অতিক্রম করেন কিন্তু ইবাদত কখন করেন? আমি তা অবশ্যই দেখবো। যখন লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ল তখন তিনি দুলহার ন্যায় পাক-পবিত্র হয়ে মসজিদে গমণ করেন এবং ইবাদতে ফজর পর্যন্ত মশগুল ছিলেন। তারপর বের হয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ফজরের নামায পড়ে যথানিয়মে পাঠদানে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং এশা পর্যন্ত তা চলতে থাকল। তখন মনে মনে বললাম আজ রাতও আমি তাঁকে পর্যবেক্ষণ করবো। দেখলাম সে রাতেও তিনি যথানিয়মে ইবাদতে মশগুল ছিলেন। তখন আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আমৃত্যু আমি তাঁর সাহচর্য পরিত্যাগ করবো না।”  

 ➥     ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান,, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৮২, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮৫


রদ্দুল মোহতার গ্রন্থে আছে,

-وقد صلي الفجر بوضئو العشاء اربعين سنة و حج خمسا و خمسين حجة وراي ربه في المنام مائة مرة ولها قصة مشهورة وفي حجة الاخير استئاذن حجبة الكعبة بالدخول ليلا فقام بين العمودين علي رجلة اليمني ووضع اليسري علي ظهرها حتي ختم نصف القران ثم ركع وسجد ثم قام على رجليه اليسرى ووضع اليمنى على ظهرها حتى ختم القران فلما سلم بكي وناجي ربه وقال الهي ما عبدك هذا العبد الضعيف حق عبادتك لكن عرفتك حق معرفتك فهب نقصان خدمته لكمال معرفته فهتف هاتف من جانب البيت يا ابا حنيفة قد عرفتنا حق المعرفة وخدمتنا فاحسنت الخدمة قد غفرنا لك ولمن اتبعك ممن كان علي مذهبك الي يوم القيامة- 

“ইমাম আবু হানিফা চল্লিশ বছর এশার উযূ দিয়ে ফজরের নামায পড়েছেন এবং ৫৫ বার হজ্জ পালন করেছেন আর স্বপ্নে আল্লাহকে একশতবার দেখেছেন যা খুবই প্রসিদ্ধ। তিনি সর্বশেষ হজ্জের সময় বায়তুল্লায় প্রবেশের অনুমতি নিয়ে রাতের বেলায় প্রবেশ করে দু’ স্তম্ভের মধ্যখানে ডান পায়ে দাঁড়িয়ে বাম পা ডান পায়ের উপর রেখে অর্ধ খতম তথা পনের পারা কুরআন তিলাওয়াত করেন। তারপর রুকু-সিজদা করে উঠে বাম পায়ের উপর দাঁড়িয়ে ডান পা বাম পায়ের উপরে রেখে পূরো কুরআন সমাপ্ত করেন। নামায শেষে অঝোর নয়নে কান্নাকাটি করে বলেন-হে আল্লাহ! আমি তোমার দুর্বল বান্দা, তোমার যথাযথ হক আদায়ে অক্ষম, তবে তোমাকে চেনার মতো চিনেছি। সুতরাং আমার যাবতীয় অক্ষমতা ও খেদমতের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তখন বায়তুল্লাহর দিক থেকে গায়েবী আওয়াজ আসল যে, হে আবু হানিফা! তুমি আমাকে-চেনার মত চিনেছ এবং উত্তম খেদমত আঞ্জাম দিয়েছ। সুতরাং আমি তোমাকে এবং তোমার অনুসারীদেরকে এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত যারা তোমার মাযহাবের অনুসরণ করবে আমি সকলকে ক্ষমা করে দিলাম।”  

    আল্লামা শামী (رحمة الله) (১৩০৬হিঃ), রদ্দুল মোহতার, খন্ড ১, পৃষ্ঠাঃ  ১২৪ ও ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩ হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৮৫, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৮৭


তাকওয়া ও পরহেযগারী


মক্কী ইবনে ইব্রাহীম (رحمة الله) বলেন, “আমি কূফাবাসীদের মজলিসে বসেছি, তাদের মধ্যে ইমাম আ‘যমের চেয়ে অধিক পরহেযগার কাউকে দেখিনি।” 

 ➥ ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৯৭, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৯৮


হাসান সালেহ (رحمة الله) বলেন, ইমাম সাহেব একজন বড় পরহেযগার ব্যক্তি ছিলেন, হারাম বস্তু থেকে বেঁচে থাকতেন। এমনকি কেবল সন্দেহের কারণে তিনি অনেক হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করতেন। আমি কোন ফকীহকে তাঁর চেয়ে বেশী স্বীয় প্রাণ ও ইলম রক্ষা করতে দেখিনি এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পরহেযগারী ও অত্যন্ত সতর্কতার সহিত জীবন যাপন করেছেন।  

 ➥    ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৯৭, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৯৮

 

হাসান ইবনে যিয়াদ (رحمة الله) বলেন, খোদার শপথ! ইমাম সাহেব কোনদিন কোন খলীফার উপঢৌকন গ্রহণ করেননি। তিনি একদা তাঁর ব্যবসায়িক শরীকদারের নিকট ব্যবসার কিছু কাপড় পাঠিয়েছিলেন। এতে একটি কাপড়ে ক্রটি ছিল। তিনি শরীকদারকে বলেছিলেন, এই কাপড় বিক্রির সময় ত্রুটির কথা বলে বিক্রি করবে। কিন্তু শরীকদার তা বিক্রি করে দিলেন কিন্তু ভুলে ত্রুটির কথা উল্লেখ করেননি এবং ঐ ত্রুটিযুক্ত কাপড় কার কাছে বিক্রি করেছে তাও সঠিকভাবে মনে ছিলনা। যখন ইমাম সাহেব এ ব্যাপারে অবহিত হলেন, তখন তিনি সন্দেহের কারণে ঐ দিনের বিক্রিত সমস্ত মূল্য সাদকা করে দিলেন, যা তৎকালীন ত্রিশ হাজার দিরহাম ছিল এবং ঐ শরীকদার থেকে পৃথক হয়ে গেলেন।  

➥   ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ৯৮, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ৯৮

 

ইমাম আবুল কাসেম কুশাইরী শাফেঈ (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত ‘রিসালায়’ বলেন, ইমাম সাহেব নিজের কর্জদারের বৃক্ষের ছায়ায় বসা থেকেও বেঁচে থাকতেন এবং বলতেন যে, কর্জ থেকে উপকৃত হওয়াটাও এক প্রকারের সূদ। এ ব্যাপারে ইয়াযিদ ইবনে হারূন (رحمة الله) বলেন, আমি ইমাম সাহেব থেকে বেশী পরহেযগার কাউকে দেখিনি। আমি একদা তাঁকে এক ব্যক্তির ঘরের দরজার সামনে প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললাম হুজুর! এই ঘরের ছায়ায় তাশরীফ নিলে ভাল হতো। তিনি বললেন, এই ঘরের মালিকের উপর আমার পাওনা কর্জ রয়েছে। আমি চাইনা যে, এর ঘরের ছায়ায় বসে এর থেকে উপকৃত হই। ইয়াযিদ বলেন-এর চেয়ে বড় পরহেযগারী আর কী হতে পারে?  

➥   ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ১০০, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ১০০


ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র উপর অর্পিত অভিযোগের জবাব


আবু আমর ইউসুফ ইবনে আব্দুল বার (رحمة الله) বলেন, যে সকল মুহাদ্দিসীনে কিরাম ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন এবং তাঁর ভূয়শী প্রশংসা করেছেন তাঁদের সংখ্যা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীর সংখ্যার চেয়ে অনেক গুণ বেশী। কেবল আহলে হাদিসরাই তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাদের অভিযোগ হলো তিনি আহলে রায় তথা যুক্তিবাদী ছিলেন। একথা প্রসিদ্ধ আছে যে, কোন ব্যক্তি সম্পর্কে মানুষের বিভিন্ন মত থাকাটাই তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। যেমন হযরত আলী (رضي الله عنه) কে নিয়ে দু’টি দল সৃষ্টি হলো।

অতি মুহাব্বতের কারণে একদল সীমালঙ্ঘন করেছে আরেক দল তাঁর বিরোদ্ধাচারণ করেছে।  

 ➥  ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ  ১৭৮, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ১৫৮

 

আল্লামা তাজউদ্দিন সুবকী (رحمة الله) বলেন অভিযোগ ও সমালোচনার উপরে প্রশংসার স্থান দিতে হবে। নতুবা আইম্মায়ে কিরামগণের মধ্যে কেউ বাঁচতে পারবে না। কোন ইমাম এরূপ নেই যে, যার বিরুদ্ধে কোন না কোন অভিযোগ নেই। ইবনে আব্দুল বার (رحمة الله) বলেন এ বিষয়ে অনেক বড় বড় ইমামগণেরও ভুল হয়েছে এবং অনেক মুর্খদল গোমরাহ হয়েছে। তারা জানেনা যে, এরূপ মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা কতবড় গুনাহ। তারপর বলেন-যাকে অধিকাংশ লোকেরা নিজেদের ধর্মীয় ইমাম মেনে নিয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকজনের সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়।  

➥  ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু, পৃষ্ঠাঃ ১৮০, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ১৫৮


এভাবে ইমাম মালিক (رحمة الله)’র বিরুদ্ধে ইবনে আবি যি’ব, ইমাম শাফেঈ’র বিরোদ্ধে ইবনে মুঈন, আহমদ ইবনে সালেহ’র বিরুদ্ধে ইমাম নাসাঈ এমনকি ইমাম বুখারী (رحمة الله)’র বিরুদ্ধেও খালিদ ইবনে আহমদ যুহলী অভিযোগ করেছিলেন। তাছাড়া ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)’র মেধা, যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, নির্ভরযোগ্যতার প্রশংসা করে যারা তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন তাদের অধিকাংশই হলেন অন্য মাযহাবের ইমাম। যেমন ইবনে আসীর জযরী, হাফিয যাহাবী, ইবনে হাজার আসকানী, আবু হাজ্জাজ আল মযযী, আব্দুল গণী মুক্দ্দসী, ইমাম নববী, ইবনে হাম্মাদ হাম্বলী, ইমাম শাফেঈ, আব্দুল ওহাব শা’রানী, ইবনে হাজার মক্কী ও জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (رحمة الله) প্রমূখ। এদের অনেকেই তাঁর পৃথক জীবনী গ্রন্থও রচনা করেছেন।

আর খতীবে বাগদাদী (رحمة الله) তারীখে বাগদাদে ইমাম আ‘যমের বিরুদ্ধবাদীদের যেসব মত নকল করেছেন তা তিনি একজন ঐতিহাসিক হিসাবে করেছেন। নতুবা তিনি নিজেই এ মতের বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তাঁর সম্পর্কে অনেক মনীষীদের কৃত প্রশংসা বর্ণনা করার পর বলেন-“আমরা (ঐতিহাসিকগণ) অন্যান্য আইম্মাদের বেলায় যেভাবে প্রশংসা ও অভিযোগ সম্পর্কীয় যাবতীয় মত বর্ণনা করি সেভাবে ইমাম আ‘যমের বেলায়ও তা বর্ণনা করেছি। অথচ আমি নিজেও তাঁর মহান মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদানকারী। আর যারা এই মতগুলো পাঠ করে অসন্তুষ্ট হবেন আমি আমার কিতাবের নিয়ম-নীতির কারণে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।” এতদ্বসত্ত্বেও অন্যান্য লিখকগণের মধ্যে কেউ ইমাম আ‘যমের বিরুদ্ধবাদীদের মতকে বর্ণনা করেননি বরং সেগুলোর যথাযথ জবাব দিয়ে তাঁকে অভিযোগ মুক্ত করেছেন।


তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীঃ


১.   كتاب العلم والمتعلم ইমাম আ‘যম (رحمة الله) এই গ্রন্থখানি আকাইদ ও নসীহতের উপর শিষ্যের প্রশ্ন ও উস্তাদের উত্তর পদ্ধতিতে রচনা করেছেন।  

 ➥      হাজী খলীফা, কাশফুয যুনূন, খন্ড ২, পৃষ্ঠাঃ  ১৪৩৭

 

২. كتاب الفقه الاكبر আকাইদ বিষয়ে রচিত গ্রন্থখানা আবু মুতী বলখী তাঁর থেকে রেওয়ায়েত করেছেন।  

➥   হাজী খলীফা, কাশফুয যুনূন, খন্ড ২,, পৃষ্ঠাঃ  ১২৮৭

 

৩. كتاب الوصايا   

 ➥   হাজী খলীফা, কাশফুয যুনূন, খন্ড ২,, পৃষ্ঠাঃ  ১৪৭০

 

৪. كتا ب الالمقصود ৫. كتاب الااوسط ৬. كتاب الاثار  ইমাম আ‘যম তাঁর ছাত্রদেরকে যে সব হাদিস ‘ইমলা’ (লিখতেন) করাতেন তা তাঁর থেকে শিষ্যরা রেওয়ায়েত করেছেন। এর মধ্যে ইমাম মুহাম্মদ (رحمة الله)’র বর্ণিত “কিতাবুল আসার” সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। যেহেতু এর হাদিস সমূহ ইমাম আ‘যম (رحمة الله) ‘ইমলা’ করায়েছেন তাই এটি তাঁর রচিত কিতাব হিসাবে ধরা হয়। যেমন ইমাম মালিক (رحمة الله)’র মুয়াত্তা ইয়াহিয়া ইবনে ইয়াহিয়া (رحمة الله) রেওয়ায়েত করলেও ইমাম মালিক (رحمة الله)’র রচিত কিতাব বলে গণ্য করা হয়। 

ইমাম আ‘যমের কিতাবুল আসারের হাদিস সমূহকে নির্বাচিত করে তাঁর ওস্তাদগণের তারতীব অনুযায়ী হাদিস একত্রিত করে মাসানিদে ইমাম আ‘যম রচিত হয়েছে। এ সব মুসনাদের সংখ্যা প্রায় ত্রিশখানা। এর মধ্যে একটি হলো মুসনাদে হাফসাকী। মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এই মুসনাদের শরাহ বা ব্যাখ্যা লিখেছেন। এই মুসনাদ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবিদ সিন্দী (رحمة الله) সংকলন করেছেন। এসব মুসনাদের অনেক উত্তম ও উন্নতমানের শরাহ লিখা হয়েছে। হাজী খলীফা “কাশফুয যুনূন” নামক গ্রন্থে তা       বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।


ওফাতঃ 


খলীফা আবু জাফর মনসুর ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله)কে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করতে বললে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। কিন্তু খলীফার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করাতে তিনি তাঁর উপর রাগ করে শপথ করলেন যে, এই পদ গ্রহণ না করলে আপনাকে বন্দী করা হবে এবং অপদস্ত করা হবে। এতেও তিনি সম্মতি প্রকাশ না করলে তাঁকে জেল খানায় বন্দী করা হয় এবং প্রতিদিন বাইরে এনে দশটি করে বেত্রাঘাত করা হয়। এভাবে দশদিন যাবৎ লাঞ্ছিত হওয়ার পর আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন এবং এরপর পঞ্চম দিন ইন্তেকাল করেন।

কেউ কেউ বলেন-তাঁকে খাবারে বিষ দেয়া হয়েছিল। তিনি তা খেতে অস্বীকার করে বলেন, আমি জানি যে, এখানে কি দেওয়া হয়েছে। আমি এ খাবার খেয়ে আমার হত্যাকারীর হত্যায় সহযোগী হতে চাই না। সুতরাং আমি তা পানাহার করবোনা। কিন্তু জোর জবরদস্তী তা তাঁর মুখে ঢেলে দিলে তিনি সিজদা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

কেউ কেউ বলেছেন পদ গ্রহণ না করার কারণে খলীফা তাঁকে এমন মর্মান্তিকভাবে শহীদ করেননি বরং এর কারণ হলো ইমাম সাহেবের প্রতি প্রতিহিংসা পোষণকারী কিছু দুশমনে খলীফাকে বলেছে যে, ইমাম সাহেব বসরায় খলীফার বিরুদ্ধ অবলম্বনকারী ইব্রাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান ইবনে হোসাইন ইবনে আলী (رحمة الله)কে সহযোগীতা ও সাহায্য করেছেন। এতে খলীফা ভীত ও ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁকে বাগদাদে ডেকে আনেন। বিনা দোষে বা বিনা কারণে হত্যা করার দুঃসাহস ছিল না তার। তাই কাযীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কেননা খলীফা জানতেন যে, তিনি কখনো এই পদ গ্রহণ করবেন না।

তিনি ১৫০ হিজরী সনে ৭০ বছর বয়সে রজব অথবা শা’বান মাসে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন) মৃত্যুকালে হাম্মাদ নামী তাঁর এক সন্তান ছিল।

তাঁর ইন্তেকালের পর বাগদাদের কাযী হাসান ইবনে আম্মার তাঁকে গোসল দেন এবং আবু রজা আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াকেদ পানি ঢালেন। গোসল দেওয়া শেষ হতে না হতেই বাগদাদের চতুর্দিক থেকে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। তাঁর জানাযায় প্রথম জামাতে পঞ্চাশ হাজারের অধিক লোক অংশগ্রহণ করে। এরপর আরো লোকজন আসতে থাকে। ফলে মোট ছয়বার জানাযার নামায পড়তে হয়েছিল। সর্বশেষ জানাযায় তাঁর পুত্র হযরত হাম্মাদ (رحمة الله) ইমামতি করেন। অবশেষে অধিক লোকের কারণে আসরের পরেও দাফন কাজ সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়নি। দাফনের পরেও বিশদিন পর্যন্ত লোকজন তাঁর কবরে জানাযার নামায পড়েছেন। তিনি অসিয়ত করেছিলেন যে, তাঁকে যেন ‘খিযরান’ নামক কবরস্থানের পূর্বদিকে দাফন করা হয়। কেননা তাঁর মতে সেখানকার ভূমি পাক-পবিত্র এবং গযবমুক্ত ছিল। এই অসিয়ত অনুযায়ী ঐ কবরস্থানের পূর্ব পার্শ্বে তাঁকে দাফন করা হয়। 

➥  ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) (৯৭৩হিঃ), আল খায়রাতুল হিসান, উর্দু পৃষ্ঠাঃ  ১৬১-১৬৪, আরবী, পৃষ্ঠাঃ  ১৪৫


 
Top